বাংলা
ভাষায় মহামান্য ও মাননীয় শব্দ দুটির সাথে গভীর শ্রদ্ধা সম্মান অন্তর্নিহিত।রাষ্ট্র
বা সমাজের বিশেষ মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষদের ক্ষেত্রেই শুধু এই শব্দ দুটি ব্যবহার
করা হয়। যারা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নিজেকে আত্নত্যাগ করে থাকে, গণমানুষের মুক্তির
জন্য প্রাণপন লড়াই করে নেতৃত্বের বিশেষ
আসনে অধিষ্ঠিত হয় ,কেবল তাদের নামের পূর্বেই মহামান্য বা মাননীয় শব্দদ্বয় জুড়ে দিয়ে তার প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়। আমরাও ভুল করিনি এই শব্দ
দুটির যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। যাদের
আত্নত্যাগে আজকের এই বাংলাদেশ সেই এ কে ফজলুল হক , মাওলানা
আবদুল হামিদ খাঁন ভাসানী ,
হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী , বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এই নামগুলোর
সাথে আপনা আপনিই মহামান্য ও মাননীয় শব্দগুলো বসে যায় গভীর শ্রদ্ধাভরে।স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ৪২ বছরের রাজনীতিতে
এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন রাজনীতি বলতে মুক্তির সংগ্রাম বোঝায় না। এখন রাজনীতি হলো,
সমাজের দুর্নীতিবাজ, চোর,দুস্কৃতিকারী,কালোবাজারীদের মহামান্য ও মাননীয় বানানোর
ফ্যাক্টরী, রাজনীতি হলো প্রাইভেট লিঃ বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং জল্লাদ তৈরির
কারখানা। রাজনীতিকে বানিজ্যে মেরুকরণ করার ফলে, এখন বাংলাদেশে রাজনীতির বাজারে
পূর্ণ প্রতিযোগিতা মূলক বাজার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বাজার ধরে রাখার জন্য দেশের প্রধান রাজনৈতিক
প্রতিষ্ঠানগুলো অবলম্বন করছে নানাবিধ মার্কেটিং পলেছি। রাজনীতি শিল্পের ক্রমবর্ধমান
বিকাশের ফলে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নানাবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেমন
রকমারি বোমা তৈরি ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম সরবারহ প্রতিষ্ঠান , আইন শৃংখলা বাহিনীর
বিরুদ্ধে লড়াই করার উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত ফাইটার সরবারহ প্রতিষ্ঠান,দেশের অবকাঠামো
দক্ষতার সহিত ধ্বংসের জন্য কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , রাজনৈতিক পন্যের
গুনগতমান (যেমন , খাদ্য, বস্ত্র,বাসস্থান,চিকিৎসা,শিক্ষা সুনিশ্চিত করণ, অবকাঠামো উন্নয়ন,
ঘরে ঘরে চাকুরীর সুযোগ ইত্যাদি) জনগনের নিকট তুলে ধরার জন্য ইলেক্ট্রনিক্স ও
প্রিন্ট মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, হয়তো এরই মধ্যে প্রস্তুতি চলছে টক শো তারকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার, কারণ সামনের রাজনীতির বাজারে ব্যাপক টক শো তারকার চাহিদা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানের রাজনীতি ব্যবসায় উল্লেখিত বিষয়গুলো সংযোজনের ফলে
ব্যবসায় অধিক মূলধন বিনিযোগের আধিক্য দেখা দিয়েছে। যার ফলে মূলধন সরবারহের জন্য
দেশের প্রধান রাজনীতি ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানগুলো বিত্তহীন মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী সংগ্রহের পরিবর্তে বিত্তবান দুর্নীতিবাজ, চোর,দুস্কৃতিকারী,কালোবাজারী সংগ্রহের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এছাড়া
বাংলাদেশের বর্তমানে গার্মেন্টস ব্যবসা,শেয়ার ব্যবসা,ব্যাংকিং ব্যবসা মন্দা থাকায়
অনেক বিনিযোগকারী এখন রাজনীতি ব্যবসার দিকে ঝুকে পড়েছেন। কিছু দিন পর পরই অনুমোদন
পাচ্ছে নতুন নতুন রাজনীতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর অনুমোদনের সাথে সাথেই রমরমা
বাজারে পড়ে থাকছেনা কেউই। প্রধান রাজনীতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় অঙ্কের টাকা,সংসদের
আসন বন্টন,মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগী চুক্তিতে কিনে নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সদ্য
গজানো রাজনীতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর
শেয়ার।এছাড়া মহামান্য ও মাননীয় হওয়ার এত সহজ ডিসকাউন্ট দেশের প্রধান প্রধান
রাজনীতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোপূর্বে কখনো দেয়নি।এই সুযোগ যথাযত ভাবে কাজে
লাগাতে অনেক দুর্নীতিবাজ, চোর,দুস্কৃতিকারী,কালোবাজারী পূর্বের
উপাধী মুছে মাননীয় সাংসদ ,মহামান্য
মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিকে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার লিজ
বা কন্ট্রাক্ট পেয়ে গেলেই লগ্নিকৃত অর্থ
ফেরতসহ,সম্পদ চারশত থেকে পাঁচশত গুন করার নিশ্চিত সুযোগ অনেক বিনিয়োগকারীর মধ্যেই
আশার সঞ্চার করেছে। ইতোমধ্যেই গত সংসদ নির্বাচনে অর্থলগ্নী করে শতভাগ সফলতা পেয়েছেন
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অনেক মাননীয় ও মহামান্য ব্যক্তিবর্গ। এই অভাবনীয় সাফল্যের ফলে বাংলাদেশে এই রাজনীতি শিল্পের সুদৃঢ় ভাবে বিকাশের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিহাসে
অনেক শব্দের অর্থ অনেক অর্থবহ ও মহিমান্বিত হলেও পরবর্তিতে কর্মপ্রক্রিয়ার ফলে ঘৃণিত হয়েছে। রাজাকার শব্দের অর্থ যত অর্থবহই হোক না কেন , বাঙলার মানুষ সব সমই এই
শব্দ দ্বারা ঘৃনা প্রকাশ করবে। তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতি বানিজ্যিকরণ করার ফলে
চলমান প্রক্রিয়ায় যেভাবে মহামান্য ও মাননীয় বানানোর মহাৎসব শুরু হয়েছে তাতে এই
শ্রদ্ধামিশ্রিত শব্দ দুটির অর্থ বাঙলার মানুষের কাছে ভিন্নতায় রুপ নিতে পারে , অদূর ভবিষ্যতে অভিধান
থেকে পরিবর্তন হতে পারে শব্দ দুটির অর্থ। তাই বাংলা ভাষার এই অমূল্য শব্দ দুটির অর্থ
অপরিবর্তিত রাখার ব্যাপারে এখনি আমাদের সজাগ ও সচেতন হওয়া উচিত নয় কি ?