রবিবার, ৩ মে, ২০২০

একটি দুর্যোগ

একটি দুর্যোগ প্রমাণ করে দিচ্ছে,
পৃথিবীর এক একটি রাষ্ট্রের সক্ষমতা এবং অক্ষমতা
একটি রাষ্ট্রের মানুষের সচেতনতা এবং অজ্ঞতা
একটি রাষ্ট্রের মানুষের উদারতা এবং স্বার্থপরতা
একটি রাষ্ট্রের রাজনীতির স্বচ্ছতা এবং অস্বচ্ছতা,
                           এবং
একটি জাতিগোষ্ঠীর সততা এবং কপটতার সীমারেখা।

শনিবার, ২ মে, ২০২০

গরমের ছুটিতে কানাপভিল গ্রাম পেরিয়ে দোভিল সমুদ্র সৈকতে

মিশেল গরমের ছুটিতে তার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে। টিভি রিমোটের কন্ট্রোল পুরোপুরিই আমার হাতে। কাজ শেষ করে বাসায় এসে সিনেমা দেখা, বারান্দায় গাছের টবগুলোতে পানি দেয়া, তিনদিনে একদিন রান্না করা আর ঘর গোছানোর কাজ এখন সপ্তাহে একদিন করলেই চলে।দিন শেষে নিস্তব্ধ নীরবতা নেমে আসা ফ্ল্যাটে নিজের মতো করে একটু ভাবনার সুযোগ; এরপর পরবর্তী দিনের শক্তি সঞ্চারের জন্য ঘুমের প্রস্তুতি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সাময়িক একাকি জীবন।


গত ৯ আগস্ট ২০১৮ থেকে শুরু হলো নয় দিনের ছোট্ট গরমের ছুটি। ভাবনায় ছিল কয়েক দিনের জন্য সবুজের চাদরে মোড়া কোনো পাহাড়ের নির্জন কোনে সময় কাটাবো। কিন্তু, দীর্ঘ দিনের কাজের ক্লান্তির আলস্য এমনভাবে শরীর আর মনকে চেপে বসেছিল যে ছুটির দিনগুলো হেলায় কেটে যাচ্ছিল।সিদ্ধান্ত নিলাম একদিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসবো। ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে আঁলিয়াস ভয়াসের একদিনের একটি ভ্রমণের রেজিস্ট্রেশন করলাম, স্থান দোভিল। 

এটি নরমাণ্ডি রেজিওর কালভাদোজ দোপার্টতোমোর একটি সমুদ্র উপকূলীয় শহর। সমুদ্র সৈকতের জন্য মূলত এই শহর অধিক পরিচিত। প্যারিস থেকে বাসে মাত্র তিন ঘণ্টার যাত্রা পথ। আজ থেকে পাঁচ বছর পূর্বে প্যারিসে বাংলাদেশের একটি আঞ্চলিক সমিতির আনন্দ ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে ইতোপূর্বে এই শহরের সৈকতের নোনা জলে আমার শরীর ভেজানোর সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এবারের ভ্রমণটা একটু ভিন্ন রকম।

ভ্রমণ এজেন্সি দিনের প্রথম পর্বে আমাদের নিয়ে যাবে কানাপভিল নামে একটি গ্রামের মদ উৎপাদনের ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে।   আমি একমাত্র এই ভ্রমণে সঙ্গীহীন পান্থ। 


১৬ অগাস্ট প্যারিসের দফের রসু থেকে আমাদের ভ্রমণ বাস যাত্রা শুরু করলো। ভ্রমণ সঙ্গীদের অধিকাংশই জীবনের পাতাঝরা শীতকালে অবস্থান করছে। দলে বসন্তের সায়াহ্নে অবস্থানকারী মানুষ আমিই শুধু। আমাদের ভ্রমণ নির্দেশনাকারীও সত্তরোর্ধ্ব প্রাণোচ্ছল মহিলা।

শহর পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ভ্রমণ বাস প্রবেশ করলো ধু ধু বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা মহাসড়কে। আমি সব সময় প্যারিসের বাইরে গেলে চলার আনন্দটা দারুণভাবে উপভোগ করি। ফ্রান্সের কৃষিভূমি এবং গ্রাম ছবির মতই সুন্দর।

তিন ঘণ্টার যাত্রা অতিক্রম করে আমরা প্রবেশ করলাম কানাপভিল গ্রামে। পাহাড়, সমভূমি এবং সবুজ অরণ্যে বেষ্টিত সুন্দর গ্রামের মধ্যে অবস্থিত সাতু দু ব্রুই। এটি এক সময়ের রাজবাড়ি হলেও এখন মূলত একটি মদ উৎপাদন কারখানা।

বৃক্ষ আর ফুলে শোভিত ছায়া শীতল সাজানো গোছানো একটি বাগানবাড়ি। প্রথম দেখাতে বোঝার উপায় নেই এটি একটি মদ উৎপাদনকারী কারখানা।

বাস থেকে নেমেই সবাই প্রবেশ করল সাতু দু ব্রুই উৎপাদিত মদের প্রদর্শনী কেন্দ্রে। এখানে নানা আকৃতির বোতলে মোড়কিকরণ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাদের পণ্য সামগ্রী।

বিক্রয় কর্মীরা দর্শনার্থীদের জন্য উৎপাদিত ওয়াইনের স্বাদ গ্রহণের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা রেখেছেন। দর্শনার্থীদের অনেকেই প্রদর্শনী কেন্দ্র ঘুরে পছন্দের স্বাদের ওয়াইন কিনলেন। এর স্বাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত যেহেতু আমি পরিচত নই তাই নতুন করে স্বাদ গ্রহণ আর হলো না। আমি নিজেকে ব্যস্ত করলাম চারপাশ ঘুরে ছবি তুলতে ।

এরমধ্যে আমাদের ভ্রমণ নির্দেশনাকারীর ডাক পড়লো। সকল ভ্রমণারথী একত্রিত হওয়ার পর আমাদের ভ্রমণ দলকে সাতুর একজন কর্মকর্তা নিয়ে গেলেন মদ উৎপাদনের প্রক্রিয়াকরণ একটি ইউনিতে।

এখানে আমাদের দেখানো হল আপেল থেকে রস তৈরির পর কীভাবে জ্বালানোর মাধ্যমে মদে রূপান্তর করা হয়। ভালোভাবে বোঝার জন্য কর্মকর্তা একটি ভিডিও প্রজেকশনের মাধ্যমে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া আমাদের সামনে তুলে ধরলেন।

এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে আপেল থেকে উৎপাদিত ওয়াইন সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণাগারটির বাহিরের চেহারা অনেকটাই আমাদের দেশের কৃষকদের ধান-গম সংরক্ষণের গুদাম ঘরের মতোই। ভেতরের দৃশ্য অনেকটাই আমাদের দেশের স্থানীয় ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী মিলের মতো।

কাঠের নির্মিত সংরক্ষণাগারে ওয়াইনে ভরপুর সুবিশাল কাঠের গোলাকৃতির কনটেইনার দুই সারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি কনটেইনারে সংরক্ষণ সংক্রান্ত লেবেল লাগানো।

আমাদের সবাই খুব আগ্রহ নিয়েই মদের এই সংরক্ষণাগারটি ঘুরে দেখতে লাগলেন। এই ওয়াইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল আপেল।আপেল গাছে ফুল ফোটা থেকে শুরু করে বাগান থেকে আপেল সংগ্রহ এবং সংগৃহিত আপেলের রস মদে রূপান্তর করে মজুদ ও বাজারজাতকরণের প্রতিটি স্তরের একটি ভিডিও চিত্র কয়েকটি কনটেইনার উপর প্রোজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হলো।

ফরাসি খাবার তালিকায় মদ ঐতিহ্যবাহী পানীয়। সমস্ত ফরাসি ভূখণ্ডে নামী ব্র্যান্ডের মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানার পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য অপরিচিত ছোট ছোট কারখানা। এমনকি ফরাসি গ্রামাঞ্চলে অনেক কৃষি পরিবারে পারিবারিক ভাবেও তৈরি হয় মদ; যেমনটি আমাদের দেশে কাঁচা আমের সময় গ্রামের অনেক পরিবার কাসুন্দি তৈরি করে থাকে।

এখানে আঙুর এবং আপেল অন্যতম কৃষি পণ্য, যা বিশেষত মদ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফরাসি রপ্তানিজাত পণ্যের মধ্যে মদ অন্যতম। আমাদের দেশের বিভিন্ন মেলায় যেমন স্থান পায় আমাদের দেশজ উৎপাদিত প্রধান পণ্যসামগ্রী আর এখানকার শহর কিংবা গ্রামে কোনো মেলার আয়োজন হলে সেখান প্রধানত স্থান পায় মদ ও পনির।

আমরা যখন সাতু দু ব্রুই থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামীণ জনপদের ভেতর দিয়ে দোভিললের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম তখন চোখে পড়ল অসংখ্য আপেল বাগান। 

দোভিল রেল স্টেশনে পৌঁছানোর পর আমাদের ভ্রমণ নির্দেশনাকারী ঘোষণা করলেন সন্ধ্যা ছয়টার সময় ভ্রমণ বাস প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। সুতরাং সবাইকে ছয়টা বাজার পনেরো মিনিট পূর্বে বাসে অবস্থান নিতে হবে।

আমি আমার ক্যামেরাকে সঙ্গী করে রওনা হলাম সৈকতের উদ্দেশ্যে। পরিচিত শহরটা এবার নিজের কাছে নতুন করে আবিষ্কৃত হল। বিগত সময় এভাবে দোভিল শহরের সৌন্দর্য আমার দৃষ্টিকে ছুঁয়ে যায়নি। শহরের ভেতর দিয়ে সৈকতে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল পাহাড়ের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে ওঠা স্থানীয়দের বসতবাড়ি, অন্যদিকে সমভূমিতে গড়ে ওঠা ভিন্ন মাত্রার স্থাপত্য শৈলীর দালান, যার অধিকাংশই হোটেল, কেসিনো, অফিস-আদালত। দেখে মনে হলো, দালানগুলোর সামনের অংশের নকশার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে কাঠের ব্যবহার করা হয়েছে।

পূর্বে নরমান্ডির আরও কয়েকটি শহরে  ভ্রমণ করলেও এবার দোভিল শহরের সৌন্দর্য যেন অন্য শহরগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে ধরা দিল।


দোভিলের সমুদ্র সৈকতে চল্লিশ মিনিট একপাশ ধরে হেঁটে অন্যপাশে যাওয়া যায়। আমার সমুদ্রের গর্জন শুনতে ভালোলাগে। তীরের বুকে ঢেউয়ের আঁছড়ে পরার দৃশ্য মুগ্ধ করে, কিন্তু নোনা জলে শরীর ভেজাতে অনীহা রয়েছে।

গতবার এই সৈকতে এলোমেলোভাবে হেঁটে বেড়িয়েছি। পুরো সৈকত ঘুরে দেখা হইনি। বেশ দূরে সুমদ্রের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা একটি টিলার মাঝে ছোট্ট একটি বাড়ি নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিলাচ্ছে। সেই সৌন্দর্য দারুণভাবে টানলো। সিদ্ধান্ত নিলাম সৈকতের তীর ধরে হেঁটে ঐ বাড়িটার কাছে পৌঁছুবো। 


আমি হাঁটছি আর সৈকতের চার পাশের মানুষের কর্মকাণ্ড দেখছি। ছোট শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে সমুদ্রে জলকেলিতে মেতে উঠেছে। সৈকতের বেলাভূমির স্বেদ চামড়ার নানা বয়সের মানুষ স্বল্প বসনে শরীরকে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত মনে সূর্যের তাপ গ্রহণ করছে।

বছরের অধিকাংশ সময় ঠাণ্ডা আবাহাওয়ার কারণে ইউরোপের মানুষের শরীর মোটা কাপড়ে ঢাকা থাকে তার উপর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সূর্যকে ঢেকে রাখে, ফলে সূর্যের তাপ থেকে তাদের শরীর হয় বঞ্চিত। তাই মাস তিনেকের রোদ্রোজ্জল উষ্ণ সময় কালে অধিকাংশ ইউরোপিয়ান সমুদ্রমুখী হয় শরীরের সাদা রঙটাকে রোদে পুড়িয়ে একটু তামাটে করার প্রচেষ্টায়।

সমুদ্রের তীর ধরে দীর্ঘ সময় হেঁটে আমার গন্তব্যে পৌঁছুলাম। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নেবার পর ফেরার পথে দেহ-মনে দারুণ এক ক্লান্তি চেপে বসতে সমুদ্রের বিশালতাকে সামনে রেখে নিজেকে এই বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির উপর সমর্পণ করলাম।

আমাদের ইট-পাথরে আচ্ছাদিত নিয়ম-কানুনের জীবন-যাপনে মাটির স্পর্শ নেবার সুযোগ খুবই কম। সমুদ্রের গর্জন, বয়ে যাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ এমন প্রকৃতির মাঝে বালুর উপর দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত চিন্তার জাল ছিন্ন করে চলে গেলাম ঘুমের ঘোরে। বিধি-নিষেধের সভ্যতার বাইরে দু’ঘণ্টার জন্য আদিমতর জীবনের নির্ভেজাল স্বাদ গ্রহণ করলাম।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা বুঝিয়ে দিলো সাগর পাড়ের কিছুক্ষণের উন্মত্ত জীবনের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শরীরের উপর জমে থাকা বালুর স্তর ঝেড়ে ফেলে আবার সভ্য সমাজের জন্য তৈরি হয়ে নিলাম।


পড়ন্ত বিকেলের উত্তাপহীন সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে চলে এলাম সারি সারি জাহাজের নোঙর করা এলাকায়। এখানে শান্ত জলাধারার মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নান্দনিক কিছু অবকাশ যাপনের দালান। খালের ওপর পাশে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা পাহাড়ি জনবসতি আর পর্যটকদের পদচারণা মুখর সৈকত দোভিল শহরকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।

সাগরের পার থেকে বিদায় নিয়ে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই চলে এলাম আমাদের দোভিল রেল স্টেশনে। উদ্বৃত্ত সময় শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীর পারে বসা বৈকালিক মেলা, আকাশে পাখিদের দলবেঁধে উড়ে বেড়ানো, শান্ত নদীর বয়ে চলা  স্রোত দেখে কেটে গেলো।


বাসে ঢুকতেই আমাদের ভ্রমণ পরিচালক মহিলা আমাকে দেখে মনে হয় একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তার হয়তো আশংকা ছিল, ভ্রমণ দলের একমাত্র সঙ্গীহীন এশিয়ান কালো মানুষটি অচেনা শহরে পথ হারিয়েছে কি! 

গরমের ছুটিতে কানাপভিল গ্রাম পেরিয়ে দোভিল সমুদ্র সৈকতে

জীবনের পরার্থপরতার মহত্ত্ব অর্জনের জন্য প্রয়োজন নেই বিশেষ পেশা ও সম্পদ।

 সেবার মধ্যেই মানব জীবনের মহত্ত্ব।এ কথা আমরা সবাই জানি।আমরা ভেবে থাকি মানুষের পাশে থেকে সেবা করার জন্য রাজনীতি করা দরকার,বিশেষ পেশার মানুষ হওয়া দরকার অথবা প্রচুর অর্থ সম্পদ থাকা দরকার যা সমস্যাগ্রস্ত  মানুষের বিপদে দান করে সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দেয়া যায়।কিন্তু,সেবা শব্দটির তাৎপর্য এতো ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে সমাজ ও জীবনের প্রতি স্তরে অবস্থান করেই মানব সেবা করে জীবনকে ধন্য করা যায়। আবার সমাজের সেবক পরিচয়ের অনেকেই রয়েছে যারা সমাজের সেবকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন মানুষের ক্ষতি সাধন করে। আমি খুব সাধারণ দৃষ্টিতে সেবা বলতে বুঝি,সেবা সেটাই, যে দায়িত্ব নিজের  উপর অর্পিত বা যে কাজ আমি করি তা সুচারু ,সঠিক এবং সততার সহিত সম্পাদন করাই হচ্ছে সেবা।যাহা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন ঘটায়। 


রাজনীতি হচ্ছে  বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সেবা করার মাধ্যম। তবে এই মাধ্যমে আমি কি উদ্দেশ্যে নিজেকে নিয়োজিত করছি সেটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়।সত্যিই যদি সমাজে শান্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে নিজেকে রাজনীতিতে নিবেদন ও আত্মত্যাগ করি তবেই আমার দ্বারা রাজনীতির সুফল সেবা হয়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। আবার কারো  রাজনীতি করার উদ্দেশ্য যদি হয় নিজের স্বার্থ অন্বেষণ করা, তবে সেই স্বার্থ হাসিল করার  কর্মকাণ্ডগুলোর নেতিবাচক প্রভাবে ভেঙে পড়বে সমাজের শৃঙ্খলা।   


 আমরা অনেকেই অর্থ বিত্তের অধিকারী হলে অনেক সময় জনকল্যাণ মূলক কাজে কিছু ব্যয় করে থাকি।এই ব্যয়ের সুবিধাভোগী মানুষের কাছে মহান মানুষ হয়ে উঠি।নামের সাথে ওঠে সমাজ সেবকের তকমা। আমরা খুঁজে দেখতে যাই না  দানকারীর অর্থশালী হয়ে ওঠার উৎস। যদি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কেউ সম্পদ উপার্জন করে, তবে শুধু সেই ব্যক্তিই নয় তার সম্পদ আহরণের প্রতিটি স্তরে তার আশেপাশের মানুষসহ রাষ্ট্র ও সমাজ সমান্তরালে উপকৃত হয়। এমন মানুষ প্রকৃতই সমাজের সম্পদ ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য এক আশ্রয় স্থল। অপরদিকে, কারো সম্পদের আহরণের পথ যদি হয় বাঁকা।অর্থাৎ,মানুষের অধিকার বঞ্চিত করে,ধোঁকা দিয়ে,সমাজের ক্ষতি সাধন করে সম্পদের পাহাড়ে দাঁড়ানোর পর যদি কেউ কল্যাণকর কাজে ব্যয় করেন, সেই ব্যয়কে সেবা না বলে বলতে হবে চাতুর্যতা।কারণ এই সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে ঐ অসৎ মানুষটি প্রতিটি স্তরে অন্য মানুষকে কষ্টে নিপতিত করেছে এবং সমাজকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে ভূমিকা রেখেছে। এই ব্যয় মূলত মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তার অপকর্মের নেতিবাচক ইমেজকে ইতিবাচক করার জন্য। কিছু মানুষ তার দানে সামান্য উপকৃত হলেও অপকর্মের কারণে পেছনের শত শত মানুষের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয় বলে সামগ্রীক সমাজের কল্যাণের স্বার্থে ও অসৎ কার্যকলাপ নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে এমন মানুষদের দানকে প্রত্যাখ্যান করাই শ্রেয়।    


আমাদের অনেকই রাজনীতি করি না এবং বিত্ত বৈভবও নেই। নিজের আয় দিয়ে সমাজের দুস্থ মানুষের আর্থিক সাহায্য করা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। মনে হতে পারে, এই জীবনে পরার্থপর হয়ে ওঠা হলো না আর।অথচ নিজের সারা জীবনের উপার্জন পরিবারের ভাইবোন,পিতামাতা ও স্ত্রী সন্তানের ভরণপোষণে ব্যয় করে কখনো উদ্বৃত্ত সম্পদ জমেনি। জীবনের এমন ত্যাগ সমাজে  দৃশ্যমান হয়না,কেউ বাহবা দেয় না,যাদের জন্য করছেন তারাও আপনার উপর খুশী নাও হতে পারে। কিন্তু, আপনার জীবনের এমন ত্যাগ যে কত বড় পরার্থপরতা সেটার তাৎপর্য অপরিসীম।  



সমাজে কিছু মানুষের দেখা মেলে,যারা পরিবারের সেবা যত্নে বড় হয়ে ওঠেন, রাষ্ট্রের অর্থে শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেন, কিন্তু সারা জীবনে না পরিবার,না সমাজ ও রাষ্ট্রের বিন্দু পরিমান উপকারে আসেন। বরং,এরা অন্যের পরিশ্রমের উপর ভর করে ভোগের জীবন পার করে । নিজে আয় করলেও সে আয়ের ছিটে ফোটাও কখনো অন্যরা পায় না। এমন মানুষদের বাহ্যিক চলাফেরায় জৌলুশ ফুটে উঠলেও ,এদের মানব জনম সার্থকতাহীন।অনেকটা পশুপাখীর জীবনের মত।কারণ, পশুপাখির জীবনে শুধু নিজের উদর ভর্তি করা ছাড়া অন্য আর কোন লক্ষ্য থাকেনা। অন্যভাবে দেখলে,সমাজের এমন মানুষদের তুলনায় একদিকে পশুপাখির জীবন সার্থকতায় ভরা,কারণ পশুপাখীরাও জীবনের একটা সময় ত্যাগ স্বীকার করে নিজের বাচ্চাদের খাইয়ে, যত্ন করে,নিরাপত্তা দিয়ে বড় করে তোলে।


অনেকে আর্তের সেবায় জীবন উৎসর্গ করার জন্য সংসার ত্যাগী হয়ে কাজ করেন কোন আশ্রমে, আবার কেউ  গড়ে তোলে জনহিতৈষী কোন প্রতিষ্ঠান।এমন সেবার সামাজিক মূল্যায়ন হলেও আমাদের সংসারে অনেক গৃহিণী রয়েছেন, যাদের কর্ম কখনো অর্থমূল্যে বিচার হয়না, অথচ সারাটা জীবন উৎসর্গিত হয় পরিবারের অন্যান্য সদ্যসদ্যের সেবা শুশ্রূষা প্রদান করে। এই সব অমূল্যায়িত গৃহিণীদের জীবনের অবদান কি ঐ সব সমাজকর্মী পরিচয়ের মানুষদের চেয়ে কোন অংশে কম? নাইবা হল সামাজিক মূল্যায়ন,এমন মানুষেরা কিন্তু মানব জনমের সার্থকতা অর্জন করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।  


আমরা সাধারণ ভাবে বুঝি, ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন করা।কিন্তু,ব্যবসার অপর নাম সেবা,সেটা কজনইবা ভেবে দেখি বা করে দেখাই। অর্থাৎ,পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করে সঠিক মূল্যে ভোক্তা বা ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়াই হচ্ছে সেবা। অন্যদিকে, নিজেকে এর মধ্যদিয়ে আত্মনির্ভরশীল করার পাশাপাশি অন্যকেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে এবং দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা ধরে রাখতে ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই অর্থে ব্যবসা একটি মহান পেশার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার মহান দায়িত্বও বটে।


অপরদিকে,যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ওজনে কম দেই,পণ্যে ভেজাল মেশাই,মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যে নতুন তারিখ বসিয়ে বিক্রি করি,শ্রমিকের প্রাপ্য  মজুরী না দেই,সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দেই, তাহলে এমন ব্যবসাকে সেবা বলতে পারি কি? বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। 

সমাজে সেবামূলক অনেক পেশা রয়েছে,যেসব পেশাজীবীদের কাজ তাদের পেশাগত সেবা দিয়ে মানুষকে পরিত্রাণ করা। অথচ, এমন মানুষদের নিকট থেকে অনেক সময় সেবার পরিবর্তে নিগৃহীত হতে হয়। 

অর্থাৎ, সেবার মাধ্যমে মানব জীবনের সার্থকরা খুঁজতে প্রয়োজন নেই বিশেষ কোন পেশা বা অর্থ বিত্ত বৈভব।দরকার প্রত্যেকের অবস্থান থেকে নিয়মানুবর্তি জীবন যাপনের মানুসিকতা। এমন জীবনাচারই জীবনের পরার্থপরতার মহত্ত্ব ও প্রশান্তি এনে দিতে পারে।জীবনের বেলা শেষে উপহার দিতে পারে পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণের পরিতৃপ্তি। 


শুক্রবার, ১ মে, ২০২০

বলছি বাংলাদেশের পরিপাটি পোশাক পরা মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীদের বৈষম্যের কথা।

সাধারণ ভাবে আমরা জানি,যিনি শ্রম দেন তিনি শ্রমিক, যিনি শ্রমের বিনিময়ে নির্দিষ্ট অর্থ উপার্জন করেন তিনিই শ্রমিক।শ্রম দুই ধরণের ১ কায়িক শ্রম ২ মানসিক শ্রম।


১৮৮৬ সালে পহেলা মে  আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।এই সমাবেশ রুখে দিতে  তৎকালীন সরকারের  মদদে শ্রমিকদের উপর গুলী চালায় পুলিশ।এতে নিহত হয় ১১ জন শ্রমিক। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হওয়া শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয়জনকে প্রহসন মূলক বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।যাদের আত্মত্যাগের কারণে আজ প্রতিষ্ঠিত কলকারখানা ও অফিস আদালতের আট ঘণ্টার শ্রমঘণ্টা। প্রতি বছর পহেলা মে আমরা ঐসব আত্মত্যাগী মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকি।এই দিবসে সাধারণত কায়িক পরিশ্রম করা  শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলি। কিন্তু যারা বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে মানসিক শ্রম দেন সেই সব স্যুট কোর্ট পরা কর্মীদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা আমরা কখনো ভাবি কি?  

বাংলাদেশের (২০০৬-২০১৩) শ্রম আইনে যারা ঘণ্টা অনুযায়ী কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জন করেন সেইসব মানুষদের শ্রমজীবীর শ্রেণীর আওতাধীন করে তাদের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।  

কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রশাসনিক ,তদারকি ও ব্যবস্থাপনা সাথে জড়িত কর্মীদের উক্ত শ্রম আইনের সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 

আমরা দেখতে পাই সরকারী অফিস আদালতে যারা কাজ করেন সেখানে পিয়ন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত সকাল নয়টা পাঁচটা অর্থাৎ আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টার সুবিধা ভোগ করে থাকেন এবং দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি।কিন্তু, এর বাইরের ক্ষেত্র অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীরা কি এই সুবিধা ভোগ করে থাকেন? কি আইনে চলে তাদের শ্রম দেয়ার সময় সীমা।তা রাষ্ট্রীয় ভাবে অনেকটাই ঝাপসা।চলে ঐ সব প্রতিষ্ঠানের মনগড়া নিয়ম নীতির উপর। 

এই আলোচনায় যাওয়ার আগে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটু বর্ণনা করে নিলে বুঝতে অনেকটাই সহজ হবে।


২০০৬ সালে বাংলাদেশে একাডেমিক পড়াশুনা সম্পন্ন হওয়ার পর জীবিকার তাগিদে একটি খাদ্য উৎপাদন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে একাউণ্টেণ্ট পদে কাজে যোগদান করি।নিয়োগের সময় নিয়োগ চুক্তি পত্রে আমার কর্মঘণ্টা নির্ধারিত হয় প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সপ্তাহে ছয় দিন, অর্থাৎ দিনে দশ ঘণ্টা করে মাসে দুইশত চল্লিশ ঘণ্টার কাজের চুক্তি।যেহেতু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরী এবং জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে কাজে যোগদান করেছিলাম।বয়সে তরুণ,প্রাণশক্তিতে ভরা জীবন, তাই  প্রথম প্রথম দিনে দশ ঘণ্টা শ্রম তেমন কিছু মনে হতোনা।কিন্তু কাজে যোগদানের পর কখনো সন্ধ্যা সাতটার সময় অফিস থেকে  বের হতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না ।কারণ, আমার সিনিয়ররা সন্ধ্যা সাতটার পর অফিসে বসে থাকতো,তারা অফিসে বসে কাজ করলে আমরা জুনিয়রেরা কিভাবে অফিস থেকে বেড়িয়ে যাই। এই ইতস্ততার কারণে আমরাও কাজ করতাম,   আর না থাকলে বসে থাকতাম ওনাদের বেরোনোর অপেক্ষায়।অধিকাংশ দিন অফিস থেকে বের হতে প্রায় রাত আটটা বেজে যেতো।আমাদের মালিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত।তিনি সারা দিন অফিসের বাইরে থাকতেন,সপ্তাহে ন্যূনতম দুই দিন সন্ধ্যা সাতটার পর অফিসে ফোন করে বলতেন আমি রাত আটটার দিকে অফিসে আসছি,জরুরী মিটিং করতে হবে, সবাই যেন অফিস থেকে না বের হয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর চরম বিরক্তি নিয়ে বসের অপেক্ষায় সবাই বসে থাকতাম।তিনি তার দেয়া সময়ের পর ইচ্ছে মত সময়ে অফিসে আসত।কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ,কখনো গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে রাত এগারোটা বাজিয়ে দিতো।উনি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মঘণ্টার মধ্যবর্তী সময়ে মিটিং করতেন না, কারণ তার প্রবণতা ছিল কিভাবে কর্মচারীদের অতিরিক্ত সময় খাটিয়ে লাভবান হবেন। ঢাকার যানজট মাড়িয়ে মধ্যরাতে বাসায় ফিরে কোনোমত খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পরতে হতো পরের দিন সময় মত অফিসে যাওয়ার জন্য।কারণ,প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের নির্দেশ সবাইকে সকাল নয়টার মধ্যে অফিসে এসে কাজ শুরু করতে হবে।তার বানানোর নিয়ম ছিল, মাসে তিনদিন সকাল নয়টার পর যারা অফিসে আসবে তাদের একদিনের বেতন কর্তন করা হবে। সেই দেরী যদি প্রতিদিন পাঁচ মিনিট করে পনেরো মিনিট হয় তবুও একদিনের বেতন কর্তন।আবার ঈদের সময় কারো চাকুরীর বয়স এক বছর পূর্ণ হতে একদিন বাকী থাকলে তার বোনাস হতো না।কারো সাথে কর্ণধারের মনমালিন্য হলে এক মুহূর্তের নোটিশে চাকুরীও চলে যেতো।সরকারের অনেক বড় বড় অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপক হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। দু একজনের ক্ষেত্রে দেখেছি, কাউকে চাকুরীতে রাখবেনা কিন্তু তাকে সরাসরি না বলে বিভিন্ন ওজুহাতে কয়েক মাসের বেতন আটকিয়ে দিতেন।একটা সময় ভদ্র লোকেরা বকেয়া বেতন ছাড়াই নীরবে অফিসে আসা বন্ধ করে দিতো। মালিকের স্ত্রীর গাড়ি চালক ছালামের বেতন হয় আমাদের হিশাব বিভাগ থেকে।একদিন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমাদের রুমে এসে বললেন, ড্রাইভার ছালামের বেতন আটকিয়ে দিতে।সবার বেতন হল কিন্তু ছালামের বেতন হল না।লোকটি বেতন ছাড়া কিছু দিন চাকুরী করে অন্য জায়গায় একটি চাকুরী ঠিক করে আমাদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেলেন।কিন্তু কিছুদিন পর পর ছালাম আমাদের হিশাব বিভাগে এসে জিজ্ঞেস করত স্যার আমার বকেয়া বেতনটা কি হয়েছে? আমাদের যেহেতু মালিকের নির্দেশ নেই তাই খারাপ লাগার শর্তেও বলতে হতো ভাই আপনার বেতনটা এখনো পাশ হয়নি তাই দিতে পারছিনা।এভাবে আসতে আসতে এবং একই কথা শুনতে শুনতে একদিন ড্রাইভার ছালাম আমাদের অফিসের প্রবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনার ভঙ্গীতে হাত তুলে বলল, আল্লাহ আমার পরিশ্রমের টাকা যে মেরে দিলো তার বিচার করো।এই বলে ছালাম চলে গেলো, আর কোনোদিন তাকে আমাদের অফিসে দেখিনি।ছালামের অপরাধ ছিল, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের স্ত্রীর পার্টিতে পরে যাওয়া একটি ড্রেস লন্ড্রিতে দেয়া হয়েছিলো, সেই ড্রেসটি ছালাম সময় মত আনতে ভুলে গিয়েছিলো।       

কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি,প্রমোশন ছিল মালিকের ইচ্ছে অনুযায়ী।এ ক্ষেত্রে প্রথমে অগ্রাধিকার পেতো নিজের আত্মীয় স্বজন,দ্বিতীয় তোষামোদি।শিক্ষা,যোগ্যতা,অভিজ্ঞতা,জ্যেষ্ঠতার বিচার বিবেচনা প্রাধান্য পেতো না কখনো।  

 মালিক অফিসের  নির্ধারিত সময়ের পরও  কখনো ফোন দিয়ে  হিশাব নিকাশ, ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইতো ।বিদেশে অবস্থান করলে মধ্যরাতে তার ফোন আসত অফিস সংক্রান্ত বিষয়ে।তিনি মনে করতেন তার কর্মচারীরা চব্বিশ ঘণ্টার কেনা গোলাম।মনে করতেন না তার মত প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, তিনি শুধু তার কর্মচারির চুক্তিবদ্ধ কর্মঘণ্টা কিনেছেন,দিনের পুরো সময় নয়।


 আমার কাজটিকে মানসিক শ্রমের আওতায় ধরা হলেও শারীরিক শ্রমও কম ছিলোনা।সারাদিন প্রতিষ্ঠানের হিশাব বইতে কলম চালানো, কম্পিউটার মনিটরে তাকিয়ে থেকে সজাগ মস্তিষ্কে কীবোর্ডে নখ চালানো,প্রয়োজনে দিনে কয়েকবার ব্যাংকে যাওয়া আসা, ইত্যাদি করতে করতে ক্লান্তি চলে আসত।মাঝে মাঝে ভুলের কারণে,কখনো অকারণে অশোভন আচরণের সম্মুখীনও হতে হতো।আবার কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজনের কলা কৌশলের প্রয়োগ করাও হতো।যাতে সবাই সম্মিলিত ভাবে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুলতে না পারে। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন অফিসের সবাইকেই পড়তে হতো।মাস শেষে যখন বেতনের সময় আসত, তখন কর্ণধারের আচরণ পাল্টে যেতো।মাসের প্রথমের পরিবর্তে তার চিন্তা থাকতো কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন কতটা দেরী করে দেওয়া যায়।প্রবণতা বেতনের অর্থটা কতটুকু বেশী সময় ব্যবসায় খাটানো যায়।বেতনটা যখন ছেড়ে দিতো তখন বোঝানোর চেষ্টা করত, আপনার চাকুরীটা কত গুরুত্বপূর্ণ,এই চাকুরীর উপর আপনার সংসার চলে, আমার দয়ার কারণে সেই চাকুরীটা টিকে আছে।আমি আপনাদের প্রভু, আপনাদের বেঁচে থাকার ত্রাণকর্তা। কিন্তু, তিনি কখনো অনুধাবন করতেন না যে যারা চাকুরী করছে এইচ আর, ইঞ্জিনিয়ারিং ,একাউণ্টস,মার্কেটিং,লজিস্টিকস,প্রকিউরমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে প্রত্যেক কর্মকর্তা কর্মচারীর স্ব স্ব শ্রম দেবার যোগ্যতা অর্জন করতে জীবনের পঁচিশ বছর কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাতে হয়েছে।সেই সাথে তাদের ত্রিশ দিনের পরিশ্রমের ন্যায্য অধিকার হচ্ছে এই বেতন। যা কিছুতেই প্রতিষ্ঠানের মালিকের দয়া দাক্ষিণ্য নয়।এমন নির্যাতন মেনে নিয়েই সবাই চাকুরী করত কারণ, চাকুরীটা চলে গেলে পরের মাসের বাসা ভাড়া আটকে যাবে, কারো বাচ্চার স্কুলের বেতন দেয়া হবে না,বাজার করার টাকা থাকবে না, গ্রামের বাড়ীতে বাবা মাকে টাকা পাঠানো হবে না, নতুন একটা চাকুরী খুঁজতে অনেকটা সময় লাগবে ইত্যাদি। আমি নিজেও এমন নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কয়কেবার কর্ম ছেড়ে দেবার প্রতিজ্ঞায় অফিসে যাওয়া  বন্ধ করে দিয়েছি, উল্লেখিত অনিশ্চয়তার কথা ভেবে আবার কর্মে ফিরেছি।মূলত, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রের তুলনায় কর্মীর আধিক্য এবং বেসরকারি চাকুরী খাতে রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরা মানুষের বিপদ ও প্রয়োজনকে পূঁজি করে এমন শ্রম শোষণের বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে।  


কথায় আছে শ্রমিকের শ্রম চুরি না করলে কখনো ধনী হওয়া যায়না।আমার প্রতিষ্ঠানের কথাই ধরি,ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় ত্রিশ জন মাসিক বেতনভুক্ত ব্যবস্থাপক ও তদারককারী ছিলেন।যাদের মূলত আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে দিনে আট ঘণ্টা শ্রম দেবার কথা ছিল।অতিরিক্ত সময় বাদ দিয়ে প্রতিদিনের চুক্তিবদ্ধ দশ ঘণ্টা সময় যদি ধরি তাহলে আমার ঐ সময়ের প্রাক্তন মালিক প্রতিদিন ত্রিশ জন কর্মকর্তার কাছ থেকে দিনে ৩০X২=৬০ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৬০x৬=৩৬০ ঘণ্টা, মাসে ৩৬০x ৪=১৪৪০ঘণ্টা,বছরে ১৪৪০x১১=১৫৮৪০ ঘণ্টা (বিভিন্ন ছুটির কারণে বছরকে ১১ মাস ধরা হয়েছে) অতিরিক্ত সময় সরকারের আইনের ফাঁক খুঁজে বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতো।প্রতি বছর এই ১৫৮৪০ ঘণ্টার আর্থিক মূল্য নির্ণয় করলে অনুধাবন করুণ প্রতিষ্ঠানের মালিক কত টাকা কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে লাভবান হয়েছেন। কর্মকর্তাদের এই ত্যাগের মূল্য প্রতিষ্ঠানের মালিক কখন কি নরম হৃদয়ে অনুধাবন করেছেন?বরং তার আচরণে সব সময় দম্ভ প্রকাশ পেতো, আমার চাকুরী করো বলেই তোমাদের জীবন চলে।


আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলাম, এখন হয়তো এমন ঘটনা মিলে যাবে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে কাজ করা অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীর কর্মক্ষেত্রের প্রাত্যহিক জীবনে। 

বাংলাদেশে একমাত্র সরকারী চাকুরী, ব্যাংক,কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্যতিত সঠিক ভাবে আন্তর্জাতিক লেবার আইন মেনে কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় না।বাকী হাজার হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লক্ষ লক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারী আমার উল্লেখিত বর্ণনার মত বঞ্চনা বৈষম্যের স্বীকার হন।কিন্তু এই বিশাল মানসিক শ্রম দেয়া মানুষগুলো দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন, সরকারকে কর দেন। কিন্তু, তাদের চাকুরী করতে হয় প্রতিদিন  চাকুরী হারাবার ভয়ে দাস মনোবৃত্তি নিয়ে।কারণ তারা চাকুরী হারালে তাদের জন্য নেই কোন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইন ও আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা।কিছু থাকলেও কাগজে কলমে যার বাস্তব প্রয়োগ একেবারেই নেই।প্রমাণ, সরকারী আদেশ অমান্য করে চলমান লক ডাউন চলা কালে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করা কর্মীদের কাজে যোগ দেবার  নির্দেশ প্রদানের ঘটনা।এই সরকারী আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানসিক শ্রম দেয়া কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যবহার করা হয় মালিকদের বানানো নিয়ম অনুযায়ী খেলার পুতুলের মত করে।যা দেখার কেউ নাই।এই শ্রেণীর মানুষ চাইলেই পারে না ডেস্ক ফেলে রিক্সার হাতল ধরতে, না পারে চুরি করতে।ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদতে হয় সারা জীবন, কিন্তু চলতে হয় হাসি মুখে। 


আমরা মাঝে মাঝে দেখি বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার সংবাদ কর্মীদের বেতন আটকে যাওয়ার ঘটনা ।বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া বেতনের জন্য রাস্তায় নামতে।একই দেশে সরকারী চাকুরী করা কর্মকর্তা কর্মচারীরা যখন মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে নাকে তৈল দিয়ে ঘুমায়।তখন বেসরকারি খাতের অনেকে কর্মকর্তাদের থাকতে হয় বেতন না পাওয়ার অনিশ্চয়তায়।এই বৈষম্য ঘোচানোর আজ সময় এসেছে।পৃথিবীর অনেক দেশেই কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীদের অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে। যার কঠোর প্রয়োগও রয়েছে।আমি ফ্রান্সে থাকি, এখানে সরকারী এবং বেসরকারি চাকুরীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র প্রবর্তিত শ্রম আইন মেনে শ্রমিক কর্মচারী নিয়োগ করা হয় এবং নিয়োগকর্তাকেও সরকারের শ্রমিক সংক্রান্ত নিয়ম নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে শ্রমিকের শ্রম ব্যবহার করতে হয় ।অন্যথায় কর্মচারীর অভিযোগে নিয়োগকর্তার আদালতের সম্মুখীন হয়ে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হতে পারে।যার দরুন একজন সরকারী কর্মচারী চাকুরী জীবনের শুরু থেকে অবসর কালীন শেষ সময় পর্যন্ত যে সুযোগ সুবিধার আওতায় থাকে,একজন বেসরকারি খাতের কর্মচারীও একই সুবিধা ভোগ করে থাকে।শ্রমিক মালিক এখানে স্বতন্ত্র।চুক্তি অনুযায়ী শ্রমঘণ্টার  পর ব্যক্তিগত ভাবে উভয়ই স্বাধীন,কেউ কারো সাথে কাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে যুক্ত নন। 


সারা পৃথিবী  এখন করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর সম্মুখীন। আর্থিক মন্দার মধ্যে সময় কাটাতে হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।এই দুর্যোগকালীন সময়েও আটকে থাকবেনা সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা। কিন্তু এই মহামারীর দোহাই দিয়ে আটকে গেছে অনেক বেসরকারি খাতের শ্রমিক,কর্মচারী,কর্মকর্তাদের বেতন।অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা বছর এইসব কর্মীদের খাটিয়ে দ্বিগুণ মুনাফা করলেও এখন তাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে, এই দুইমাসের ব্যবসায়ীক মন্দায় তারা রাস্তার ফকির হয়ে গিয়েছে।কর্মচারীর বেতন দেবে কোথা থেকে। দুর্যোগ যে কোনো সময় আসতে পারে, ব্যবসা কখনো ভালো,কখনো মন্দ সময় কাটাতে পারে।সেই বিষয় মাথায় রেখেই বেসরকারি খাতের  কর্মকর্তা  কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষায় বেতন ভাতা সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় বিশেষ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ অতীব জরুরী। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা চেয়ার টেবিলে বসে মানসিক শ্রমের বিনিময়ে ব্যবসায়ের লভ্যাংশ ভোগ করেন না। তারা ব্যবসায়ে অধিক মুনাফা কালীন সময়েও নির্ধারিত বেতন পেয়ে থাকে।অধিক মুনাফার কারণে দ্বিগুণ বেতন পায় না।সুতরাং মন্দা কালীন সময়ে কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা নিয়ে বেসরকারি খাতের টালবাহানাও গ্রহণযোগ্য নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের অনিয়ম ও বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরী। সেই সাথে বৈষম্যের স্বীকার লক্ষ লক্ষ মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীদের সোচ্চার আওয়াজ অপরিহার্য। 

আজকের এই মহান মে দিবসে ঐসব নীরবে নিভৃতে বৈষম্যের স্বীকার হওয়া  কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা এবং প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কথা বলার আহ্বান।