সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০

ফরাসি নাট্যমঞ্চে দ্যুতি ছড়াচ্ছে বাংলাদেশী নাট্য অভিনেতা সোয়েব মোজাম্মেল।

সোয়েব মোজাম্মেল, থিয়েটার ধ্যান জ্ঞান নিবেদিত প্রাণ এক নাট্য অভিনেতা।নিভৃতচারী এবং নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থেকে জীবনের প্রশান্তি খোঁজেন।১৯৮৮ সালে  ঢাকা’র  মুরাদপুরে এক সন্ধ্যায় নাটকের মহড়া দেখতে যায়, সেই মহড়ায় নাটকের শিশুশিল্পীর অনুপস্থিতে নাট্য নির্দেশক তাকে শিশুশিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করান।তার অভিনয় দেখে পরবর্তীতে তাকেই নাট্য নির্দেশক ঐ নাটকের শিশুশিল্পীর চরিত্রে মঞ্চে অভিনয় করান।সেখান থেকেই নাট্য মঞ্চে প্রথম যাত্রা। নাট্যমঞ্চের প্রেমে পড়ে  ১৯৯০ সালে যোগদেন চট্টগ্রাম শিশু থিয়েটারে। এরপর থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্যতম নাট্যদল  চট্টগ্রাম অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ে একজন নিয়মিত নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।নিজের পেশাগত কাজের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন নাট্যোৎসবে নাটক নিয়ে ঘুরেছেন বিভিন্ন অঞ্চল, কুড়িয়েছেন নাট্যমোদী মানুষের ভালোবাসা।বাংলাদেশে তার অভিনীত ও প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে,এসো দেশ গড়ি, ভোট পাগলা,অদ্ভুত ভূত, চিচিঙ্গে  এন্ড কোং, এই পিরীতি সেই পিরীতি নয়, সাজন মেঘ, তাইরে নাইরে না,  ভবঘুরে, চক্রবৃদ্ধি,মীন কন্যা, মেঘের ভেলা, কালোচাঁদ উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে দেশ ছেড়ে চলে আসেন শিল্প সংস্কৃতির তীর্থভূমি  ফ্রান্সে।শেকড়হীন বিভূয়ে শুরু হয় নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম।নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটলেও ছুড়ে ফেলতে পারেনি শিল্পের নেশা,বরং আরও যত্নে আগলে ধরছেন।এখন জীবন সংগ্রাম এবং শিল্পই যেন তার জীবন।  

এখানে আসার পর পরিচয় হয় সমাজকর্মী প্রদীপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে।তিনিই প্রথম তাকে ফরাসি মঞ্চে অভিনয় করার জন্য অনুপ্রেরণা ও নানাভাবে সহযোগিতা করেন।


বিভিন্ন সময়ে ফরাসি দেশের  নানা  উৎসবে ভিনদেশী মানুষদের নিকট তুলে ধরেছেন দেশীয় লোকজ শিল্প লাঠি বাড়ি  খেলা। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ফ্রান্স সংসদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের সুন্দর রক্ষা আন্দোলনের তাৎপর্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার জন্য করেছেন একক পথ নাটক। 


দৃঢ় সংকল্প ,কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম মাধ্যমে সোয়েব মোজাম্মেল এখন স্থান করে নিয়েছেন  ফরাসি নাট্য মঞ্চে। নাট্য নির্দেশক মারি লামাশের (Marie Lamachère) নির্দেশনায় এ বছর জানুয়ারি মাসে ফ্রান্সের মনপেলিয়ে (Montpellier) শহরে মঞ্চস্থ হয়  নাট্যকার বারবারা মেতের ( Barbara Métais) নাটক দো কোয়া ইয়ের ছোরা ফে( De quoi hier sera fait) ।এই নাটকটির মাধ্যমে বাঙালি নাট্য অভিনেতা শোয়েব মোজাম্মেল প্রথম ফরাসি মঞ্চে পা রাখেন। প্রথম নাটকেই অভিনয় দক্ষতা দেখিয়ে তিনি মন জয় করে নেন ফরাসি দর্শকদের। বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট বাণিজ্য , শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্রাণ প্রকৃত ও পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মানব সভ্যতা কতটা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে তারই বাস্তব চিত্র নাটকটিতে ফুটে উঠেছে।উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশ, কানাডা, ফ্রান্স,আলজেরিয়ার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।নাটককে জীবন্ত করে ফুটে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় বাংলা, ফরাসি, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষা।এই নাটকে  সোয়েব মোজাম্মেল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে একজন উদ্বাস্তু বাঙালির ভূমিকায় অভিনয় করেন। নাটকের অনেক অংশে তার মুখে শোনা যায় বাংলা ভাষায় উচ্চারিত সংলাপ। পরবর্তীতে নাটকটি  রাজধানী প্যারিস শহরে মঞ্চায়ন হয়। ফ্রান্সের অন্যান্য শহরে নাটকটি মঞ্চায়নের পরিকল্পনা থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে থেমে আছে। 



ফ্রান্সে  বাঙালিদের শিল্প সংস্কৃতি চর্চা সাধারণত কমিউনিটি ভিত্তিক, কিন্তু ফরাসি মূল ধারার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে যারা নিজেদেরকে যুক্ত করেছেন তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। সোয়েব মোজাম্মেল সেই কয়েকজন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। 

একজন নাট্যশিল্পী হয়ে ওঠার জন্য শোয়েব মোজাম্মেল কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন নাট্যনির্দেশক অ্যাডভোকেট এনামুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, আমিনুল ইসলাম মুকুল, আকবর রেজা,শিশির দত্ত সহ অনেক গুণীজনের কথা। যাদের সান্নিধ্য,পরামর্শ  ও দিকনির্দেশনা তাকে নাট্যধ্যানী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।এছাড়া ফরাসি মঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ভাষাগত সমস্যায় সবসময় পাশে পেয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসনাত জাহানকে।  



ফরাসি মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি  ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলা আবৃত্তি শিল্পীদের নিয়ে সোয়েব মোজাম্মেল নিয়মিত আয়োজন করেন কবিতা পাঠের আসর।  


বাংলাদেশের  অনেক গুণী শিল্পী এখন ফ্রান্সে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন কিন্তু সঠিক দিক নির্দেশনা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ফরাসি মূলধারার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চান না।

সোয়েব মোজাম্মেল যেন সেই সব প্রতিভাবান শিল্পীদের নিকট এক দ্যুতিময় ধ্রুবতারা, এক অনুপ্রেরণা।বাংলাদেশ থেকে আসা প্রত্যেক নাট্যজন একদিন এক একজন সোয়েব মোজাম্মেল হয়ে ফরাসি মঞ্চে  আলো ছড়াবে, সেটাই  প্রত্যাশা। ফরাসি নাট্যমোদী দর্শকরা ভাববে, ফ্রান্সে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষ শুধু অর্থ উপার্জনের জন্যই আসে না, কেউ কেউ শিল্পের সৌন্দর্যে মোহিত করতেও আসে।