আমাদের সমাজে আইন কানুন,রাজনীতি,নীতি নৈতিকতার জ্ঞান,বিবেকবোধ জাগানো আদর্শের বাণী,ধর্মীয় দর্শন সবই রয়েছে, যার দ্বারা গড়ে ওঠার কথা একটি আদর্শ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।কিন্তু,বাস্তবে এর বিপরীতে গড়ে উঠেছে একটি নীতি বিবর্জিত অমানবিক সমাজ ও অনিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।সকল প্রকার আদর্শের বাণী এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চতুরদের স্বার্থ সিদ্ধির মুখের বুলি সর্বস্ব বিজ্ঞাপন।যার বাস্তব প্রয়োগ ও ব্যবহার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রায় অনুপস্থিত।একটি উচ্চ পর্যায়ের ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের বসবাস।ভোগই আমাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম ভোগবাদী জীবন নিশ্চিত করাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত।ভোগের জন্যই আমাদের শিক্ষা অর্জন করা, রাজনীতি করা, ব্যবসা বাণিজ্য করা, চাকুরী করা এবং ভোগের জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনা করা ।একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে একজন সৎ, সমাজ সচেতন, কর্মক্ষম এবং স্বনির্ভর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে রাষ্ট্র ও সমাজের সেবা করার মধ্য দিয়ে নিজের জীবনকে সুন্দর ভাবে উপভোগ করা। কিন্তু, আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য স্থির হয় শিক্ষা জীবন শেষে একটি ভালো উপার্জনের পেশা নিশ্চিত করে অর্থ বিত্ত উপার্জনের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা।কারণ,আমাদের দেশের সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড অর্থের মাপকাঠিতে নির্ধারিত,সততা ও ত্যাগের উপর নয়।আর,সেই লক্ষ্যে অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করা একজন ব্যক্তি যখন কর্ম ক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন নির্ধারিত পারিশ্রমিক বা বেতনের বাইরে অতিরিক্ত উপার্জনের পথ খুঁজতে হন্য হয়ে ছোটে।ফলে, তার কর্ম বা সেবার মান উন্নয়নের চেয়ে অর্থ দ্বারা পকেট ভারী করার দিকে অধিক মনোনিবেশ ঘটায়।প্রত্যেকেরই সীমার রশি ছিঁড়ে ইচ্ছে মত যা খুশী তাই করে শীর্ষে অবস্থানের অসুস্থ কামনা বাসনা।
আমাদের দেশের কোন পেশার একজন মানুষের নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তার মাসিক আয়ের পরিমাণ যদি হয় একলক্ষ টাকা এবং এই আয়ের সীমারেখার মধ্যেই তাকে সমাজের মানুষের পরিপূর্ণ পেশাগত সেবা নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু,ক্ষেত্র বিশেষ আমাদের সমাজের অনেক পেশাজীবী মানুষ তার মাসিক আয়ের এই এক লক্ষ টাকার সীমার মধ্যে না থেকে তার মাসিক আয়ের লক্ষ্য স্থির করে পাঁচ লক্ষ টাকা, আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আইন ও নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জনের মাধ্যমে অনিয়ম ও অন্যায়ের সঙ্গে দোস্তি করে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন করে শুধুই নিজের ভোগবাদী জীবনকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
শিক্ষক,আমলা,পুলিশ,পিয়ন,কেরানী,ব্যবসায়ী, রিক্সা চালক এমন কোন পেশা নেই যে ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম রয়েছে।নিজে অধিক ভালো থাকার জন্য নিয়ম অমান্য করে যে চক্রের মধ্যে আমরা আমাদের সমাজকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছি তার ফলাফল কি আসলেই আমাদের ব্যক্তি জীবনকে সুন্দর করছে? অধিক কাগজের অর্থের কি সত্যিই মানুষের ভালো রাখার ক্ষমতা রাখে? যদি সমাজ ব্যবস্থা সঠিক নিয়মের মধ্যে না থাকে।
ধরুন,আপনি একজন ফল ব্যবসায়ী, অধিক মুনাফার লক্ষ্যে ফলের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য ক্ষতিকারক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে ফল বিক্রি করেন এবং এভাবে অধিক মুনাফা অর্জন করে ভাবেন, আপনিই হয়তো শুধু বিষ মিশিয়ে লাভবান হয়ে বাজার থেকে ভেজালমুক্ত চাল,ডাল,শাক সবজি,ঔষদ ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে সমাজের অন্যদের তুলনায় ভালো আছেন। অন্যরা হয়তো আপনার এই কৌশল এখনো আয়ত্ত করতে পারেনি।আপনার এমন ভাবনা সম্পূর্ণই ভুল। নিজে অধিক ভালো থাকার জন্য প্রতিদিন আপনি যেমন মানুষের হাতে সুস্থ মস্তিষ্কে বিষ তুলে দিচ্ছেন,অন্যজনও আপনার মতোই আপনার প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীতে বিষ মিশিয়ে প্রতিদিন আপনার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, যা আপনি আপনার অজান্তেই প্রতিনিয়ত ভোগ করে তিলে তিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভয়ংকর বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যে বিপদ থেকে আপনার প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের স্তূপ আপনাকে রক্ষা করতে অক্ষম।ভয় ভীতি প্রতারণা,চাতুরতা ও অসততার মধ্যদিয়ে অসীম সুখের আশায় আমরা যে অর্থের পিছে জীবন ভর ছুটে চলছি সেই অর্থ উপার্জনর উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়াই আমাদেরকে অসুন্দর ও কষ্টের জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে শুধুই আমাদের উপলব্ধি জ্ঞানের অভাবে।
একজন ঠিকাদার হয়ে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইমারত নির্মাণের কাজ পেয়েছেন। অধিক মুনাফার আশায় রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে ভবন তৈরি করছেন আপনার সন্তানদের বেশী সুখে রাখার আশায়।কিন্তু,ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তায় বিভোর থাকায় একবারও আপনার উপলব্ধি হয়নি যে আপনার প্রিয় সন্তানটি যেদিন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাবে সেদিন অন্যদের সাথে সেও ভবন ধ্বসে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকবে।
পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়ে পরিবারের জৌলুসপূর্ণ জীবন যাপন উপহার দিতে হয়তো কোন মাদকের গডফাদারকে সমাজে মাদক ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করছেন,কিন্তু আপনার অগোচরে আপনার প্রিয় সন্তানটিই মাদকাসক্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না, সে বিষয়ে কি নিশ্চিয়তা দিতে পারেন ?
শিক্ষক হয়ে টাকার নেশায় ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা না দিয়ে কোচিং ব্যবসা করে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।কিন্তু, আপনার কারণে শিক্ষা বঞ্চিত মেধাহীন ছাত্রটি একদিন বখাটে হয়ে কোন এক রাতের নির্জন রাস্তায় আপনাকে একা পেয়ে আপনার পেটেই ছুরি ঢুকিয়ে দিতে পারে, সে কথা কি একবার গভীর ভাবে ভাবেন?
বিচারক হয়ে কোন প্রভাবশালী’র ধর্ষক ছেলেকে টাকা বিনিময়ে বাঁচিয়ে দিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে নষ্ট করেছেন।বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে একদিন ওই প্রভাবশালীর নষ্ট ছেলের দ্বারা যদি আপনার প্রিয় কন্যা বা আত্মীয় ধর্ষণের স্বীকার হয়, তখন আপনার অসততার উপার্জন কি এই অঘটনের সমাধান এনে দিতে পারবে।
ডাক্তার হয়ে ঔষদ কোম্পানির উৎকোচ গ্রহণ করে মানুষকে অপ্রয়োজনীয় ঔষদ লিখে পকেট খসাচ্ছেন।অপ্রয়োজনে মানুষের শরীরে ছুরি চাকু চালানোর ব্যবস্থা করে রমরমা ক্লিনিক ব্যবসা করে সুউচ্চ অট্টালিকা বানিয়েছেন। কিন্তু, সেই বিলাসবহুল অট্টালিকায় আপনার আনন্দের জীবন যাপনের ব্যাপ্তি যে সুদীর্ঘ হবে সেই নিশ্চয়তা আপনি কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবেন? কারণ, আপনি ডাক্তার হলেও অনিয়মতান্ত্রিক সমাজের নিত্যদিনের ভেজাল পণ্য সামগ্রিক ভোগ করে আপনার জীবনও অন্যদের মত একই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
একজন ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা হয়ে ক্ষমতার দম্ভ ধরে রাখার জন্য সুকৌশলে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু করেছেন, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে যে দিন ক্ষমতার পালাবদল হবে, একই নিয়মে সেদিনের আপনার পরিণতির কথা ভুলে গিয়ে ভোগবাদী রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবদান রেখে চলছেন কি আশায়? বলতে পারেন?
অসুস্থ ভোগবাদী মানুসিকতা ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে আমরা সবাই একে অপরকে বিষ খাওয়াচ্ছি এবং খাচ্ছি,ধোঁকা দিচ্ছি এবং ধোঁকা খাচ্ছি, অন্যয় করছি এবং অন্যায়ের স্বীকার হচ্ছি কিন্তু তবুও আমাদের বোধের দুয়ার খুলছে না আত্মকেন্দ্রিক ভাবনার কারণে। আমাদের অদূরদর্শী চিন্তার ফলে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ বানিয়ে একটি ভয়ংকর সমাজ গড়ে তুলে সমগ্র জাতিকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিতে সামগ্রীক ভাবে সহায়তা করে যাচ্ছি।
আমাদের সমাজের চলমান প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একটি ইট পাথর কাঠ কংক্রিটের সমাজ বানিয়েছি যার বাহ্যিক অবয়ক সুন্দর হলেও সেই সুন্দরের মধ্যে মানবিক প্রাণ নেই।ইট কাঠ পাথরের মতই অনুভূতিহীন মানব সমাজে পরিণত। ফলে, খুন,ধর্ষণ,অন্যায়,অত্যাচার,দুর্নীতির মত ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধির সঙ্গে আপোষ করেই চলে আমাদের প্রাত্যহিক দিনপুঞ্জ।
আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অজ্ঞতা,কুসংস্কার,অধিকার অসচেতনতা,সামাজিক মূল্যবোধের অভাবের কারণে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে গেছে সমাজের নিম্ন মানসিকতার অযোগ্য মানুষদের হাতে।সাধারণত একজন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতার মূল ব্রত হয় সমাজ ও সমাজের আপামর মানুষের সেবার ভেতর দিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা। এই ব্রত যারা গ্রহণ করবে তাদের জীবন হওয়ার কথা সাদামাঠা কারণ ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ করে বৃহত্তর স্বার্থে তার জীবন উৎসর্গ ,বিনিময়ে মানুষের ভালোবাসা,শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে পরিপূর্ণ। অথচ, আমাদের দেশে যারা জনগণের সেবার দায়িত্ব নেন এবং সেবা পাওয়ার আশায় জনগণ যাদেরকে সেবার দায়িত্ব দেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দেখা যায় সেবকদের ব্যক্তিগত জীবন ভোগ বিলাস,জৌলুশের চাকচিক্যে ভরে ওঠে।অন্যদিকে, যে সাধারণ মানুষদের সেবকদের সেবা পেয়ে সচ্ছল সুন্দর জীবন পাওয়ার কথা তাদের জীবন দুষ্ট চক্রের ফাঁদে পড়ে দুঃখ দুর্দশা হতাশায় চক্রে ঘুরতে থাকে। রাজনীতি মানে « জনগণের সেবা « যা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে চরম মিথ্যে কথা। রাজনীতি মানে পূঁজিবিহীন সবচেয়ে বেশী দ্রুত মুনাফা আহরণের ব্যবসা। আর উন্নয়ন মানে হল আমাদের সেবক নামধারী নেতাদের মুনাফা আহরণের ক্ষেত্র।আমাদের শাসন ব্যবস্থায় কাগজে কলমে গণতান্ত্রিক পদ্ধুতির প্রচলন থাকলেও তাও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর মতই দূষিত এবং ভেজাল।
পৃথিবীর সবচাইতে সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হচ্ছে রাজনীতিবিদরা।কারণ, এদের ত্যাগ ও অবদানের উপর ভর করেই একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ হয়।
আবার এদের গোয়ার্তমি, অদূরদর্শিতা,দম্ভ,লোভ, অসততার কারণে একটি দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা আজ সেই আবর্তনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি।
একটি দেশের শাসন প্রক্রিয়া যদি পরিচালিত হয় অনিয়মের মধ্যে তাহলে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম গ্রাস করবে এটাই স্বাভাবিক।একটি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সৎ নেতৃত্বই পারে একটি জাতিকে নিরাপদ জীবন উপহার দিতে।নিজের ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই আমাদের সকলের সংগ্রাম হওয়া উচিত ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি নিয়মতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হওয়া।