মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
মানবিক ও ঐক্যের বাংলাদেশ গড়তে রাজনীতিতে লাঠিয়াল মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে পা রেখেছি।দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন ও জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আসলেও এখনো পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ মানবিক জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ এবং সমঅধিকার ও সমবণ্টনের একটি সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে অন্যতম অন্তরায়।
জাতিগত ভাবে আমরা আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা সম্পন্ন জাতি।আমরা প্রত্যেকেই একটি ধ্যান ধারণা নিজের মধ্যে গভীর ভাবে লালন করি সেটা হল, আমার চাই, আমাদের চাই না। আমার হলে অন্য কেউ পেল কি পেল না তাতে আমার যায় আসে না।আর একারণেই আমাদের পরাধীনতার ইতিহাস সুদীর্ঘ।আমাদের করে ভাবনার মানুসিকতা নেই বলেই আমাদের কোন সাম্রাজ্য ছিল না, সাম্রাজ্যের স্বপ্ন ছিলোনা এবং এখনো নেই। তবে যখনই আমাদের স্বার্থকে আমার স্বার্থ ভেবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি তখনি আমাদের জাতিগত বড় অর্জন ধরা দিয়েছে।যেমন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার অর্জন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ অর্জন,ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে একানব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন। এই মহান অর্জনগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী জাতি কিন্তু কেউ সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে বত্রিশ কোটি হাতকে ঐক্যবদ্ধ করলে যে কোনো অসাধ্যকে সাধ্য করার সামর্থ্য বাঙালি জাতির রয়েছে, তা ইতিহাস প্রমাণ করে।মধ্যপ্রাচ্যের মত মাটির নিচে আমাদের তেল সম্পদ নেই,ইউরোপ আমেরিকার মত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র নেই। আমাদের যা আছে তাহলো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ » মানব সম্পদ »। পলল ভূমির পলি মাটির মত নরম আমাদের জাতিগোষ্ঠীর মন।আমরা যেহেতু সমাজ সচেতন,বিজ্ঞান মনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ নই তাই আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা জন্য যোগ্য নেতৃত্ব ও যোগ্য রাজনৈতিক শক্তি অপরিহার্য।আমরা যেহেতু নিজস্ব চিন্তা শক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি এবং সিদ্ধান্ত প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি তাই আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে মানবিক ও প্রগতিশীল জাতি গঠনে যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ।যে নেতৃত্বেের দ্বারা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি যুদ্ধের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমার প্রাপ্তি নয় আমাদের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারি। দুর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেই নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক শক্তি আমাদের সামনে আসেনি। এখন পর্যন্ত যাদের পেয়েছি তাদের প্রত্যেকেই আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় বিভাজন প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে একটি অসৎ, অমানবিক জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশে অবদান রেখে চলছে…।।
বাঙ্গালি জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করতে হবে আর মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করলে রণাঙ্গনের জীবন বাজী রাখা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অবদান ও আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অন্তরে লালন করতে হবে। যদি তা করতে না পারি, তাহলে ভাবতে হবে আমি বাঙ্গালি জাতির কচুরিপানা প্রজাতির একজন মানুষ, আমার কোন শক্ত শেকড় বাকর নেই। যখন আমরা পকেটে একটি পাসপোর্ট ,একটি জাতীয় পরিচয় নিয়ে দেশ বিশেষ ঘুরে বেড়াই তখন মনে করতে হবে এই পাসপোর্ট এই পরিচয়পত্র এমনি এমনি আমাদের পকেটে ডুকে যায়নি।এই জাতীয় পরিচয় পত্র জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগী মানুষদের ত্যাগের ফসল।তা নাহলে বাঙালি হয়ে এখনো বিশ্বের বুকে পাকিস্তানি পরিচয়ে বেঁচে থাকতে হতো। পৃথিবীর অনেক জাতি জাতিগত নিজস্ব একটি স্বীকৃতির জন্য যুগের পর যুগ ধরে আত্তহুতি দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু স্বীকৃতি মিলছে না। তাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে অর্জন তা আমাদের জাতির ইতিহাসের একটি শ্রেষ্ঠ অর্জন।এই অর্জনের অবদান রাখা প্রতিটি মানুষ বাঙালি জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষ।আমি মনে করি,আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর অবদান যেমন বড় করে দেখি, তার অবদানকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, ঠিক সেই ভাবেই স্মরণ করা উচিত রণাঙ্গনের থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করা কৃষক শ্রমিক মুক্তি যোদ্ধাকেও।যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু যেমন শত্রুর কারাগারে জীবন ও মৃত্যুকে পাশাপাশি রেখে সময় পার করেছেন, তেমনি তার ডাকে সারা দেয়া প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ « জীবন » যা একবার হারালে আর ফিরে পাওয়া যাবে না এ কথা ভুলে গিয়ে জীবন ও মৃত্যুকে পাশাপাশি রেখে খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ করেছেন। আজ আমরা ব্যক্তি স্বার্থের কারণে এভাবে ভাবতে পারিনা। যেখানে স্বার্থ তার জয়গান করি আর যেখানে পাওয়ার আশা নেই তাকে ভুলে যাই।মুক্তিযোদ্ধারা আমাদেরকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন কিন্তু সেই রাষ্ট্রে মানুষের সমঅধিকার ও সমবণ্টন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমাদের ছিল যা আমরা আজও পেরে উঠতে পারিনি।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আমরা কাউকে বঙ্গবন্ধু,বীরশ্রেষ্ঠ,বীর উত্তম,বীর বিক্রম, বীর প্রতীক,বঙ্গবীর,বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধিতে ভূষিত করেছি।এই উপাধিগুলো ঐসব মহান মানুষদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।একজন মুক্তিযোদ্ধা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনের স্বাদ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে জীবন উৎসর্গ করার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন। অনেকই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, অনেকেই যুদ্ধ শেষ করে প্রাণ নিয়ে বীরের বেশে ফিরে এসেছেন।স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই দেশ পুনর্গঠনে কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন,যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেউ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে পুনর্বহাল হয়েছেন, কেউ স্বস্ব কর্মে ফিরে গিয়েছেন।এই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ নীতি আদর্শ ধরে রেখে জীবন যাপন করেছেন, কেউ বিতর্কিত কর্মে জড়িয়েছেন।একজন মুক্তিযোদ্ধা মানেই তিনি মহামানব নয়, তিনি মানুষ।জাতির ক্রান্তিকালে দেশের প্রয়োজনে তিনি জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু তার মানেই এই নয় তার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিক হবে।মানুষ তার জীবনের চলমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। সেই সিদ্ধান্ত কখনো সঠিক হয় আবার ভুল হয়,অন্যদিকে একজন মানুষের একটি ভুল সিদ্ধান্ত যদি যাদের পক্ষে যায় তারা প্রশংসা করে আবার যাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় তারা সমালোচনায় সরব হয়।এটাই বাস্তবতা।যেমন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু আর শাসক বঙ্গবন্ধু এক সত্ত্বা নয়। তার মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন ও আস্থার নিদর্শন পাওয়া গেলেও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের শাসক বঙ্গবন্ধুর দেশ পরিচালনার জন্য নেয়া অনেক সিদ্ধান্তের উপর অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের কঠোর সমালোচনা রয়েছে, দেশের অনেক মানুষের অনাস্থা রয়েছে। শাসক বঙ্গবন্ধু যদি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েও থাকে সেইটিকে ধরে তার দেশমুক্তির অবদানকে খাটো করে দেখা নেহায়েত মূর্খামি ছাড়া কিছু নয়।আর শাসন কার্যে নেয়া কোন সিদ্ধান্তে ভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক শক্তির কঠোর সমালোচনা থাকা রাজনীতিরই একটি অংশ।তাই বলে ভুলে গেলে চলবে না বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সাড়া দিয়ে একটি নিরক্ষর জাতি বুঝে না বুঝে একটি সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে একটি স্বাধীন মানচিত্র তৈরি করেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সেনাপতি জিয়াউর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জন্য কি করেছে সে আলোচনা রাজনৈতিক। শাসক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিটির ইতিহাসে স্মরণীয় হবে নাকি বর্জনীয় হবে তা নির্ধারিত হবে তার রেখে যাওয়া কর্মের দ্বারা।তার রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ অথবা বর্জন নির্ধারণ করবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে। তবে তিনি জাতির ক্রান্তিকাল মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আমাদেরকে ঋণী করেছেন সে কথা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এবং তার অবদানের জন্য গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করি।বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা তরান্বিত করণে অবদান রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান একটি আলোচিত নাম।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর খুনের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার থাকার অভিযোগে তার বীর উত্তম খেতাব বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। যা আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে ধৃষ্টতা মনে হয়েছে।
ধরা যাক, একজন মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং তার অবদান মূল্যায়নে সম্মাননা স্বরূপ খেতাবে ভূষিত হয়েছে, সেই একই মানুষ যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চিন্তা চেতনা পরিবর্তন হয়ে একজন খুনি মানুষে রূপান্তর হয় তবে তার অপকর্মের বিচার হবে রাষ্ট্রীয় আইনে। দোষী প্রমাণিত হলে রাষ্ট্র তাকে সাজা দেবে কিন্তু তার অপকর্মের জন্য ভালো কর্মের স্বীকৃতি কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র বা কোন সরকারের জন্য সমীচীন কি? কারণ, রাষ্ট্রের জন্য ওই মানুষের আত্মত্যাগ মানুষটির কাছে জাতিকে ঋণী করেছে ।একজন মানুষের অপকর্মের জন্য রাষ্ট্র শাস্তি নিশ্চিত করবে, আবার ভালো কর্মের জন্য পুরস্কার দেবে এটাই নিয়ম।কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ যখন একটির সঙ্গে আরেকটি মিলিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয় তখন বিশেষ কোন স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রের আভাস প্রকাশ পায়। যার ভেতর দিয়ে হীন ও কপট চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।রাষ্ট্রের চেয়ারে বসা দায়িত্বশীলদের এমন সিদ্ধান্ত জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, যে বিভাজন জাতিগত ঐক্যের শক্তি খর্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আজ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতায়।বৈধ অবৈধ উপায় অবলম্বন করে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় চেয়ার ধরে রাখার কারণে দেশে অঘোষিত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।ফলশ্রুতিতে দেশের প্রত্যেকটি শ্রেণী পেশার মানুষ নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা ও প্রাপ্তির জন্য অনিচ্ছার সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনদের প্রশস্তি গেয়ে থাকে। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও আজ রাজনীতির মঞ্চে সরকারের প্রশস্তিগীতি গাইতে শোনা যায়। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিলুপ্তির পথে।দমন পীড়ন নীতির কারণে মানুষ ভালো মন্দ মত প্রকাশের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সরকারের কোন সিদ্ধান ও কাজের ভালমন্দ বিচার বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা দেশে চর্চা হয়না। যার ফলে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত সামগ্রিক জাতির স্বার্থে মঙ্গলকর কিনা তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের ভাবা উচিত, আমরা এক সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেব কিন্তু দেশের জন্য আমাদের রেখে যাওয়া কোন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কিনা। মুষ্টিমেয় স্বার্থবাদী মানুষের সমর্থনে নেয়া কোন সিদ্ধান্ত নিজ রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে ফেলবে কিনা,সেই সাথে দেশ বিশৃঙ্খলার মুখে পতিত হবে কিনা তা সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে গভীর ভাবে ভাবা উচিত। যেহেতু আপনারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী একটি রাজনৈতিক দল তাই আপনাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশী এবং দেশের প্রতি আপনাদের দায়িত্বও অনেকাংশে বেশী।মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশের প্রতিটি মানুষ,প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তি আপনাদের উপর আস্থা রেখেছিল বর্তমানে সেই আস্থার রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব অন্যদের থেকে আপনাদের উপর বেশী বর্তায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই বিশ্বাসের জায়গাটা আজ আপনাদের দ্বারাই চূড়ান্ত নষ্টের পথে।
কোন বড় আন্দোলন সংগ্রাম ও অর্জন শুধু একক নেতৃত্বের কারণেই সফল হয়না।নেতাকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকা বিজ্ঞজন, সমর্থন দিয়ে রাজপথে থাকা কর্মীদের সরব উপস্থিতির কারণেই সফল হয়ে ওঠে একটি অভিযান।মুক্তিযুদ্ধে শুধু বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধানে আমরা সফলতার মুখ দেখিনি।তার পাশে থাকা রাজনৈতিক বিজ্ঞজনের পরামর্শ এবং রণাঙ্গনে প্রত্যেক শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ এবং তার দৃঢ়চেতা মনোবলের সমন্বয়ে আমরা এতো বড় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিলাম। আজ মুক্তিযুদ্ধ বলতে নতুন প্রজন্ম শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি চেনে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না,বঙ্গবন্ধুর কর্মময় রাজনৈতিক জীবন জানে না, চেনে না তার পাশে থাকা বিজ্ঞজন এবং আত্মত্যাগী মানুষদের দেশের জন্য রেখে যাওয়া অবদান।দেশে এক টাকার মুদ্রা থেকে হাজার টাকার মুদ্রায় শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। অথচ এক হাজার টাকার মুদ্রায় বঙ্গবন্ধুকে রেখে অন্য মুদ্রাগুলোতে কি ইতিহাসের অনন্যা ত্যাগী মানুষদের প্রতিকৃতি রাখা যায় না? প্রতি জেলার আনাচে কানাচে আজ ছেয়েগেছে শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আর আবক্ষ মূর্তিতে অথচ তার পাশাপাশি মাওলানা ভাসানি, এ কে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী সহ বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা, ব্রিটিশ বিরোধী' ভাষা আন্দোলন এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের আত্মত্যাগী সংগ্রামী, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সংগ্রামী কবি সাহিত্যিকদের প্রতিকৃতি স্থাপন করে নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরে শেকড়ের সন্ধান দিতে পারি, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারি ।প্রতিটি অঞ্চলের রাস্তা বা সড়ক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করে তাদের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে করতে পারি।স্বার্থান্বেষী মহলের চাটুকারী পরামর্শে শুধু বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু জয়ধ্বনি করে সমগ্র জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে।প্রকৃত স্বাধীনতার চেতনা ধারণকারী দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুকে নিঃস্বার্থেই ভালবাসে আর চাটুকার স্বার্থান্বেষী শ্রেণী তাকে নিয়ে বাণিজ্য করেছে এবং এখনো করছে।অথচ বঙ্গবন্ধু নিজেই দেশের স্বার্থে চাটুকারদের ঘৃণা করতেন।
দেশের রাজনীতিতে আজ লাঠিয়াল মনোবৃত্তি বিদ্যমান,যার ফলে এতো বিভাজন। মনে রাখতে হবে, যে মানুষটি আওয়ামেলীগ করে, কম্যুনিস্ট পার্টি করে,জাতীয় পার্টি করে ,বিএনপি করে তারা কেউ ভিনদেশী মানুষ নয়, সবাই এই দেশে জন্ম নেয়া বাংলাদেশী।সবারই দেশ নিয়ে ভালো মন্দ ভাবার অধিকার রয়েছে।আর এই অধিকার নিশ্চিত করতে প্রথমত নিজেকে একজন বাংলাদেশী ভাবতে হবে এবং একে অন্যের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও মতামতকে গুরুত্ব দেবার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমরা নিজেরাই যদি একে অন্যের মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করি, অসম্মান করি তাহলে ভিনদেশিরা নিজ স্বার্থে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে সুবিধা নেবে।যে পরিস্থিতি দেশে বর্তমানে বিরাজমান। আমরা যদি লাঠিয়াল মনোবৃত্তির রাজনৈতিক ধারা থেকে দেশকে মুক্ত করতে না পারি তাহলে একটি মানবিক ও ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু ধোঁয়াশাই থেকে যাবে।
‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো৷’
ফরাসি দার্শনিক « ভলতেয়ার »