শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০২২

মানুষের প্রকৃত শ্রেণী এবং প্রসঙ্গ সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

আমাদের মধ্য অনেকেই নিজেকে একজন সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে।বাংলাদেশে সাধারণত হিন্দু,বৌদ্ধ ,খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী  ও উপজাতীয়রা নিজেদের সংখ্যালঘু দাবী করে থাকেন এবং রাষ্ট্রীয় ভাবেও এই সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত হয়।

ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ব্যতীত অনন্যা ধর্মাবলম্বী ও উপজাতীয়রা নিজেদেরকে সংখ্যালঘু দাবী করে থাকেন। 

সংখ্যালঘু শব্দটির সাথে দুর্বলতা, দয়া,করুণা,অনুগ্রহ মিশ্রিত ভাব মাখানো। অর্থাৎ, কোন মানুষ যখন নিজে থেকেই বলে আমি একজন সংখ্যালঘু ,তখন তাকে খুব দুর্বল মনে হয়,তার প্রতি এক ধরনের করুণার ভাব জেগে ওঠে।কারণ তিনি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের দলের মানুষ নয়।শক্তিশালী সংখ্যা গরিষ্ঠরা  তাকে যে কোন সময় ছোবল দিয়ে গ্রাস করতে পারে। 


মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু শ্রেণী নির্ধারণের পূর্বে প্রথমেই ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে একটু আলোচনা দরকার। প্রতিটি ধর্মের অনুসারী অদৃশ্য শক্তি বিশ্বাস করে, মৃত্যু পরবর্তী জীবন বিশ্বাস করে,পাপ পুণ্যের ফলাফল বিশ্বাস করে, নিজের ধর্মীয় আদর্শকে শ্রেষ্ঠ আদর্শ দাবী করে সেই আদর্শের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর বুকে মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।সেই বিবেচনায় পৃথিবীর এমন বিশ্বাসের মানুষদের এক গোত্রের মানুষ বলা যায়।পৃথিবীতে আর এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা অদৃশ্য শক্তি বা কোন বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী নয়। যাদেরকে বলা হয় নাস্তিক অথবা অজ্ঞেয়বাদী। যাদের সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ষোল শতাংশ। অর্থাৎ,মানুষকে বিশ্বাসী অবিশ্বাসীদের দলে বিভক্ত করলে পৃথিবীতে ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অবিশ্বাসী মানুষ সংখ্যালঘু। ধর্মীয় বিশ্বাসী মানুষ নিজেদেরকে মানবতাবাদী ও সেরা আদর্শের মানুষ দাবী করলেও আচরণ ও কর্মের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ মেলে একটা অংশের।আরেকটা অংশ বিভাজনে বিশ্বাসী, অর্থাৎ নিজের রাস্তাকে সঠিক দাবী করে অন্যের পথকে ভুল প্রমাণের জন্য দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হতে সবসময় অগ্রভাগে অবস্থান করে  থাকে এবং নির্মম ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।এদের দ্বন্দ্বের মূল কারণ তাদের কট্টর ভাবনা।অর্থাৎ,এক ধর্মে যাহা পূর্ণ,স্বর্গে যাওয়ার পথ, অন্য ধর্মে তাহা পাপ,নড়গের রাস্তা। আল্লা বা ঈশ্বরের প্রেমে মগ্ন আরাধনাকারী কিংবা কোন দেবতার পূজারী যখন ঐ পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে মগ্ন থাকে সেই প্রতিটি ধ্যান মগ্নতার মধ্যে থাকে চরম পবিত্রতা ,সৌন্দর্য ও পরম প্রাপ্তির প্রশান্তি।এটা যার যার অবস্থান থেকে মেনে নিতে পারে না বলেই এক ধর্মের ধার্মিকের সাথে অন্য ধর্মের ধার্মিকের দ্বন্দ্ব আজকের পৃথিবীতে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। 


অনেকেই আছেন, এই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দে না জরিয়ে মানবতার কেতন উড়িয়ে পার্থিব পৃথিবীকেই স্বর্গময় বানানোর প্রেমে মগ্ন, আধ্যাত্মিকতা লালন করলেও বিশেষ কোন ধর্মের প্রতি প্রীতি নেই তাদের।

ধর্মীয় বিভাজন পরিত্যাগকারী নাস্তিক বা অবিশ্বাসী মানুষও নিজেদের মানবতাবাদী ও সেরা মানুষ হিসেবে দাবী করে থাকে। অনেকের আচরণ ও কর্মে তার দাবীর যৌক্তিকতাও ধরা মেলে।অনেকর আচরণের মধ্যে প্রকাশ পায় ধর্মবিশ্বাসী মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা, বিদ্বেষ, হিংসা,জিঘাংসা। অর্থাৎ মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী মানুষদের মধ্য থেকে বৃহৎ একটি অংশ এক পথে সহবস্থানে হাঁটছে। তাদের মধ্যে প্রত্যেকের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। মানবতা ও শান্তির পক্ষে তারা এক শক্তি।তাদের প্রতিপক্ষ, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য বিশ্বাসের মানুষের রক্ত দেখে বন্য আনন্দের  উল্লাস করে। এই শ্রেণী অনেকটা শুকনো বারুদের মত, ম্যাচের কাঠির ঘষা লাগলেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায়।দেখা যাচ্ছে,পৃথিবীতে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে যারা  মানবতা ও শান্তির পক্ষে তারা একটি পক্ষ।অন্যদিকে, ধর্ম বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে অজ্ঞ,অশিক্ষিত ও বিশৃঙ্খল মানুষেরা অন্য একটি পক্ষ।এভাবে চিন্তা করলে, হিন্দু মুসলিমের প্রতিপক্ষ নয়, নাস্তিক আস্তিকের প্রতিপক্ষ নয়,খ্রিস্টান ইহুদীর প্রতিপক্ষ নয়, বৌদ্ধ জৈনের প্রতিপক্ষ নয়।পক্ষ দুটি,  এক মানবতাবাদী, দুই মানবতাবিরোধী। আমি যে বিশ্বাসের মানুষই হই না কেন,উল্লেখিত বিশ্লেষণের আলোকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে আমি মূলত  কোন পক্ষের?  

  

বাংলাদেশে যখন কোন ব্যক্তি বা পরিবার অমানবিক ঘটনার স্বীকার হন তখন এক শ্রেণীর ক্ষুদ্র পরিসরের চিন্তা ধারার মানুষ ঐ নিগৃত ব্যক্তি বা পরিবারের  ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে এনে পরিস্থিতি  ঘোলা করার কাজে নিপ্ত হন।ঐ নিগৃহীত ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় যদি মুসলিম না হয়ে থাকে। ভারতের ক্ষেত্রে যদি হিন্দু না হয়ে থাকে। 


প্রথমত রাষ্ট্রের কাছে প্রতিটি মানুষের মূল্যায়ন একজন নাগরিকের হিসেবে।ধর্মীয় পরিচয় মূল্যায়নের মানদন্ড নয়।ধর্মীয় পরিচয়ে অন্যের উপর প্রভাব খাটানো ও করুণা ভিক্ষা দুটোই অন্যায়।   রাষ্ট্রের কাছ থেকে  অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য আমার নাগরিকত্বের পরিচয়ই সবচেয়ে বড় ভিত্তি ও সম্মানের। যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে নাগরিকের জাতীয়তা বা নাগরিকত্বের  পরিচয়কে মূল ভিত্তি হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে সেই রাষ্ট্রকে আমরা আদর্শ রাষ্ট্র বলতে পারি। 


আমি বিশ্বাস করি,মানুষের দ্বারা সংগঠিত সমাজের চলমান অন্যায়,অবিচার, অত্যাচার মানুষের ধর্ম চর্চার ফসল নয়, বরং ধর্মীয় জ্ঞানহীনতার ফসল। কিন্তু আমরা যখন কোন অপকর্ম সংগঠিত হতে দেখি তখন সেটাকে অপকর্মকারীর ধর্ম পরিচয়কে সামনে এনে ঘটনার দায়কে ব্যক্তির উপর না চাপিয়ে ধর্মের উপর চাপিয়ে অন্যায়কারীকে বাঁচিয়ে দেবার চেষ্টা করি। এই প্রবণতা আমাদের উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের অস্থি মজ্জাগত।  


২০১৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশে ১১ বছরের এক হিন্দু শিশুকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে ৫৫ দিন জোরপূর্বক ধর্ষণের এক নির্মম ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।

চকরিয়া ও মহেশখালী উপজেলার ছয় মাদক ব্যবসায়ীর একটি চক্র গাজীপুর থেকে শিশুটিকে স্কুল থেকে ফেরার পথে অপহরণ করে, পরবর্তীতে ঐ গ্রুপের মানিক নামের এক সদস্য শিশুটিকে ধর্মান্তরিত করে কথিত বিয়ের নামে ধর্ষণ করতে থাকে।

কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে পুলিশের চেষ্টায় শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। এরপর এই অমানবিক ঘটনার জন্য যতটা না পশু মনোবৃত্তির অপকর্মকারীকে দোষারোপ করা হয়েছে তার চেয়ে বেশী একশ্রেণীর মানুষ ঐ দোষীর ধর্মীয় পরিচয়কে কাঠগড়ায় তোলার প্রাণপণ চেষ্টায় মেতে উঠেছে। প্রশ্ন, এই জঘন্য অপরাধী কি ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিল এবং তার দ্বারা সংগঠিত এই অপরাধ কি তার ধর্ম চর্চার ফসল? কিংবা সমাজের সংগঠিত ধার্মিকদের সহযোগিতায় কি এমন অপকর্ম সংগঠিত হয়েছে? যদি না হয়, তবে কেন এই অপরাধের সঙ্গে  ইসলাম শব্দটি যোগ করে জল ঘোলা করার চেষ্টা ? এতে বরং অপরাধীর বিচারকার্যকে বাধা সৃষ্টি করে ধর্মীয় সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া হয়েছে। 

আসলে জন্মগত ভাবে কোন ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় যথার্থ নয়, ধর্মীয় দর্শন চর্চা ও পালনের মধ্যেই ধার্মিকের পরিচয়। 


মন্টু শীল, পেশায় একজন নরসুন্দর। রাজবাড়ী জেলা শহরের পান বাজারে অবস্থিত নিজস্ব মালিকানাধীন সুন্দর সাজসজ্জার পরিপাটি হেয়ার ড্রেসারে কাজ করেন।তার মিষ্টভাষী এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণের কারণে সমাজের শিক্ষিত,অশিক্ষিত,ধনী দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষ তার কাছে চুল দাড়ি কাটতে যায়।কাজ চলাকালীন সময়ে সেবা গ্রহীতাদের সঙ্গে সদালাপী মন্টু শীলের পারিবারিক,সামাজিক,রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গল্পগুজব চলে।এই গল্পের মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে সেবা গ্রহীতাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়।সেই বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে পারিবারিক বন্ধুত্বে রূপ নেয়। তার দোকানের আশেপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও খুবই সুসম্পর্ক বিদ্যমান।কারণ, কোন প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে তিনি টাকা ধার করলে তা যথাসময়ের পূর্বেই পরিশোধের চেষ্টা করেন। তিনিও পরিচিত কারো প্রয়োজনে তার সাধ্য অনুযায়ী সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।ইত্যাদি কারণে মন্টু শীল শুধু নরসুন্দর হিসেবেই নয়, একজন বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন এবং পরিচিতি লাভ করেন।

রাজবাড়ী শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত প্রমত্ত পদ্মা।পদ্মার ওপারে বিশাল চরাঞ্চল।এই চরাঞ্চলের মানুষের জীবন কৃষি নির্ভর।রাজবাড়ী বাজারের সাপ্তাহিক হাটের দিন এই অঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল, গবাদি পশু নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য।এই চরাঞ্চলের অনেকের সঙ্গে কাজের সুবাদে মন্টু শীলের বন্ধুত্বের সম্পর্ক।অনেকই তাদের ফসল ও গবাদি পশু বিক্রির অর্থ দিনশেষে নদী পাড়ি দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভয় পেতেন ছিনতাই হওয়ার ভয়ে। যার দরুন বিক্রিত অর্থ, স্বর্ণালংকার মন্টু শীলের কাছে আমানত রেখে নিশ্চিন্তে বাড়ী ফিরে যেতেন। মন্টু শীলও আমানতের খেয়ানত করতেন না।এমন বিশ্বস্ততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করার কারণে মন্টু শীল এক প্রকার অবাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিণত হয়ে ওঠেন। প্রয়োজনে বড় অঙ্কের টাকা মন্টু শীল অন্যের কাছ থেকে ধার নেন এবং অন্যেকে প্রয়োজনে দেন।এভাবে চলে বছরের পর বছর। 


মন্টু শীলের হেয়ার ড্রেসার বন্ধ থাকে না কখনো। কখনো সে না থাকলেও তার কর্মচারীরা কাজ করে। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সকাল থেকে রাত অবধি মন্টু শীলের হেয়ার ড্রেসার বন্ধ।কেউ চুল কাটাতে এসে, কেউ আমানতের টাকা তুলতে এসে, কেউ ধার নিতে এসে ফিরে গেলেন। ভাবলেন হয়তো আগামীকাল দোকান খুলবে। পরের দিনও লোকজন সকাল থেকে রাত অবধি দোকানের ঝাপ বন্ধ পেলেন। এভাবে প্রায় চার পাঁচ দিন পার হয়ে গেলো।সবাই ভাবলেন, মন্টু শীল কোন বিপদে পড়েছেন কিনা ।কারণ তার আশে পাশের ব্যবসায়ীরাও তার খোঁজ খবর জানে না। তার হিতাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু এবং যাদের মন্টু শীলের কাছ থেকে জরুরী প্রয়োজনে অর্থ বা স্বর্ণালংকার ফেরত নেবার প্রয়োজন তারা তার ভবদিয়া গ্রামের পালপাড়ার বাড়ীতে খোঁজ নিতে গেলেন। তারা গিয়ে দেখলেন মন্টু শীলের ভিটেবাড়ী পড়ে আছে কিন্তু কোন মানুষের আনাগোনা নেই। প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো চার পাঁচ দিন যাবত এই বাড়ীতে কোন মানুষ নেই এবং তারা জানে না এই বাড়ীর লোকজন কোথায় গেছে। যাদের অর্থ,স্বর্ণালংকার গচ্ছিত রয়েছে মন্টু শীলের কাছে তাদের মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হতে লাগলো।চিন্তা করলো, জলজ্যান্ত একটা মানুষ এবং তার পরিবার কোথায় উধাও হয়ে গেলো ব্যবসা বাণিজ্য ও ভিটে মাটি ফেলে।তদন্ত শুরু হল,একে একে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব অবিশ্বাস্য তথ্য। প্রথমে জানা গেলো, মন্টু শীলের বশত বাড়ী বিক্রি হয়েছে প্রতিবেশী ডাঃ সুনীল শিকদারের কাছে এবং  হেয়ার ড্রেসারের দলিল ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে কয়েক লক্ষ টাকা ঋণ তোলা হয়েছে। আর এসবের পূর্বে যা হয়েছে তাহলো, পরিবারের সকল সদস্যের নামে এলাকার বিভিন্ন এনজিও থেকে তোলা হয়েছে ঋন।ছোট ভাই ঝন্টু শীল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহারাইন থাকে, কয়েকজনকে সেই দেশে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা তোলা হয়েছে, বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ধার নিয়েছে মন্টু শীল, সেই সাথে পাঁচ দশ হাজারের ছোট খাটো ধার নিয়েছে অনেকের কাছ থেকে। কিছু দিন ধরে বাড়ীর দামী আসবাস পত্র সরানো হচ্ছিলো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতো শ্বশুর বাড়ীতে পাঠানো হচ্ছে। মানুষের আমানত,ধার ও ঋণকৃত অর্থ মিলে প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকার আমানত ছিল মন্টু শীলের কাছে।সময়টা ১৯৯৯ সাল,তখনকার দিনের পঁচিশ লক্ষ টাকা বর্তমান অংকে প্রায় এক কোটি টাকা।সবকিছু অতি গোপনে ও চতুরতার সঙ্গে গোছগাছ করে মানুষের বিশ্বাসের এই আমানত এবং বাবা মা ও ভাইদের পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে মন্টু শীল এক রাতে পারি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।ব্যাপারটি যখন নিশ্চিত ভাবে জনসম্মুখে চলে আসে তখন রাজবাড়ীর মুখরোচক আলোচনার বিষয় ওঠে। মন্টু শীল যাদের অর্থ আত্মসাৎ করে তাদের মধ্যে দুই একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যতীত সবাই ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের। 


এই বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য ঐ সময় মানুষ যতটানা মন্টু শীলকে দায়ী করে তার চেয়ে তার ধর্মেকেই মানুষ বেশী দোষারোপ করতে থাকে।অনেকে গালি দিয়ে বলে, শালার মালায়নের জাতটাই খারাপ,এই দেশের খায় আর দেশের মানুষের সাথেই গাদ্দারি করে ওপারে পাড়ি জমায়।

প্রশ্ন, মন্টু শীলের এই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ কি গীতা বা মহাভারত ধর্ম চর্চার ফল? আমি মনে করি,মন্টু শীল এবং তার পরিবার যদি সত্যি হিন্দু ধর্মের বিধিবিধান মোতাবেক জীবন যাপন করতো এবং ধার্মিক হতো, তবে অবশ্যই এই অপকর্মের সীমানার কাছেও পা বাড়াতো না।আমার হিন্দু ধর্মের জ্ঞান একেবারেই নগণ্য,তবে এটুকু হলপ করে বলতে পারি, গীতা বা মহাভারতে অবশ্যই হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের অন্যের আমানতকে খেয়ানত করার নির্দেশ দেয়া হয়নি 

তাহলে কেন মন্টু শীলের মত বিশ্বাসঘাতক এবং মানিকের মত পশু মনোবৃত্তির মানুষদের অপরাধের সঙ্গে ধর্মের সংযোগ খুঁজে তাদের অপরাধকে সবসময় মাটি চাপা দেয়ার চেষ্টা করি ?   

(মন্টু শীলের ঘটনার তথ্য সূত্রঃ সাপ্তাহিক রাজবাড়ী কণ্ঠ,প্রকাশ ২ জুন ১৯৯৯) 



যখন কোন নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে তার ধর্মীয় পরিচয় সামনে এনে নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা বা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে তখন সেই নাগরিক নিজেই নিজের নাগরিকত্বের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে ।এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব অধিকারের শক্তি স্বাভাবিকভাবেই খর্ব হয়ে যায়।একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী ও বিচিত্র চিন্তা ধারার মানুষের বসবাস থাকবে।প্রতিটি চিন্তাধারার মানুষ বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রের মধ্যে এক একটি স্বাতন্ত্র্য চরিত্র।প্রতিটি চরিত্রের সমন্বয়ে সাধনের মাধ্যমেই একটি রাষ্ট্রের সুন্দর স্বরূপ ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রের মূল কাজ প্রতিটি মানুষের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তার সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। তবে কোন  কট্টর বিশ্বাস বা আদর্শের  প্রভাব যদি কোন  ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর  সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অন্যের অধিকার হরণে উদ্বুদ্ধ করে তবে তা কঠোর হস্তে দমন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সজাক থাকা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। 


আমাদের দেশে যখন কোন হিন্দু,বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা কোন উপজাতীয় পরিবার দুর্বৃত্তদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হয় তখন নিজ নিজ ধর্মের মানুষ ও সংগঠন সরব হয়ে প্রথমেই বলে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু পরিবার নির্যাতনের স্বীকারের হয়েছে বা বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা উপজাতি পরিবার নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। বলা হয় না, ঐ অঞ্চলের একটি পরিবার দুর্বৃত্তদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রথমেই কারো মনে হবে যে দেশের একটি শক্তিশালী ধর্মীয় গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়েছে তাদের উৎখাতের জন্য এবং দেশে নিজ ধর্মের আধিপত্য আরও সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য।কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। আমাদের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল  বিশেষত ভারত,বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ধর্মের নামে মানুষের উপর যে সহিংসতা, নির্যাতন ও নিপীড়ন চলে তা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু আমরা যখন বাস্তবতার নিরিখে প্রতিবাদ মুখর না হয়ে বরং তাদের পুতে রাখা ফাঁদে পা দিয়ে তাদেরই সুরে সুর মেলাই তখন জয়টা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দিকে ঝুঁকে যায়, পরাজয় হয় সাধারণ মানুষের।

সবল কর্তৃক দুর্বল আগ্রাসনের স্বীকার, কথাগুলো অতি পরিচিত, পুরাতন, ধ্রুব সত্য এবং বাস্তব। যা আমি নিজেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমার বাস্তব জীবনের পর্যবেক্ষণের থেকে।এই সবল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের সবল নয়,কোন মতাদর্শের সংখ্যাগরিষ্ঠ সবল নয়, এই সবল হচ্ছে অর্থবিত্ত, দেশের সংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পদমর্যাদার সবল।পৃথিবীতে দল দুটো, সবল এবং দুর্বল। বাদবাকী যত দল তা সবলদের স্বার্থে সবলদের দ্বারা সৃষ্ট।আমরা বোকারা বুঝে না বুঝে সেইসব দল উপদলে বিভক্ত হয়ে তাদেরই স্বার্থ রক্ষা করে চলছি মাত্র।    


আমার ছেলেবেলার একটি পারিবারিক গল্প দিয়েই শুরু করি, আমি একজন মুসলিম পরিবারের মানুষ। আমার পরিবারও মনে প্রাণে ধর্ম বিশ্বাস করে এবং যথাসাধ্য ভাবে পালনের চেষ্টা করে থাকে।আমাদের এলাকার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী।হাতে গোনা কয়েক ঘর হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। আমার বাবার কোন আপন ভাই নেই।তিনি নিজ পরিবার আর চাকুরী নিয়ে নিরিবিলি ছিমছাম জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আত্মীয় স্বজন যারা আছে তারাও নিরীহ প্রকৃতির অতিশয় ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ।কিন্তু নিজে শান্ত থাকলেই কি আমাদের সমাজে নিরিবিলি জীবন যাপন করা সম্ভব?  


আমাদের বাড়ীর একপাশের সীমানার সঙ্গে যে প্রতিবেশীদের সীমানা তারা এলাকার মধ্যে লাঠিয়াল প্রকৃতির দাঙ্গাবাজ মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ।ধর্মীয় পরিচয়ে তারাও মুসলিম।তাদের আপন ও চাচাতো শরীকদের বাড়ী পাশাপাশি।ন্যায় ভাবে হোক আর অন্যায় ভাবেই হোক তাদের যে কোন শরীক সদস্য কারো সাথে সংঘাতে জরালে তাদের সকল শরীক এক হয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে বদলা নেয়। এই হিংস্র স্বভাবের কারণে এলাকার মানুষ তাদের গোষ্ঠীর মানুষদেরকে ভয়ে সমীহ করে চলে। এমনি এক পরিবারের সঙ্গে আমাদের বাড়ীর সীমানা।আমি খুবই ছোট্ট, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি।তখন ঐ প্রতিবেশীদের দাবী উঠলো, আমাদের বাড়ীর সীমানার ভেতরে প্রায় দুই হাত জমি তাদের রয়েছে যা আমরা ভোগ করছি।তাদের দাবীকৃত জমি মধ্যে যে সব বড় গাছপালা রয়েছে সেগুলো সহ জমি ছেড়ে দিয়ে আমাদের সীমানা বেড়া সরিয়ে নিতে চাপ দিতে লাগলো আমার বাবাকে। কিন্তু আমার বাবা দীর্ঘ দিনের ভোগ দখল করা আইন সম্মত জমি ও নিজ হাতে বড় করে তোলা গাছপালা ফেলে তাদের কথা মত সীমানা বেড়া সরাতে রাজী হলেন না। তার দাবী, জমি মেপে না বোঝা পর্যন্ত তিনি তার সীমানা ছেড়ে ভেতরে আসবেন না।কিন্তু, তাদের দাবী এখনি সরে যেতে হবে।বাবা প্রতিদিন অফিস করে বিকেলে বাসায় আসলেই চলে তাদের হুমকি ধমকি। বাবাও তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এমন আবদার মানতে না পেরে।কয়েক দিন এমন উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর একদিন আমার বাবার সামনে তারা জোর ঘাঁটিয়ে আমাদের সীমানা বেড়া ভেঙ্গে ফেলল। আমার বাবা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল কিন্তু কোন প্রতিবাদ করতে পারলনা, কারণ তিনি একা আর তারা সংবদ্ধ। তিনি জোর খাটাতে গেলে হয়তো তারা শারীরিক আঘাত করবে সেই ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে দেখছেন জোরপূর্বক নিজের বসত বাড়ীর বেড়া ভাঙ্গার দৃশ্য।প্রশাসনের সাহায্য নেবার কথা চিন্তাও করতেন না বাবা।থানায় অভিযোগ করা মানে দুই দিকের ঝামেলা আরও বাড়ানো। এক প্রশাসনিক সহায়তার বদলে বরং পুলিশকে ঘুষ দেয়া এবং থানায় হাজিরা দেয়ার জটিলতা বাড়বে অন্যদিকে প্রতিপক্ষের হিংসাত্মক আচরণ আরও বৃদ্ধি পাবে। পরবর্তীতে সেই সমস্যা একটা সমাধান হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমঝোতার মধ্যদিয়ে। সমঝোতার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের পরিবারের সময় কাটত এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। তাদের লোভ ছিল মূলত আমাদের জমির সীমানারবর্তী বেশ কিছু পুরনো গাছের দিকে। সেই সময়ে গাছগুলোর আর্থিক মূল্য ছিল অনেক। যদি জোর জবরদস্তী করে আমাদের সীমানা বেড়া সরাতে পারতো তাহলে তাৎক্ষনিক তাদের গাছগুলো দখলের ইচ্ছে পূরণ হতো। 

এ সমস্যার সমাধানের দীর্ঘদিন পর আবার তাদের দাবী উঠলো,আমাদের সীমানার পাশের গলির রাস্তা দিয়ে তাদের রিক্সা নিয়ে যেতে সমস্যা হয় তাই এখানে চওড়া রাস্তা বানানো দরকার।এবার পৌরসভার আইন দেখিয়ে আমাদের জমি থেকে আরও একহাত জমি দখল করে রাস্তা চওড়া করার স্বপ্ন দেখতে লাগলো তারা। আমার বাবাকে সরাসরি না বলে আমাদের ঘরের পাশে তাদের কয়েকজন জড়ো হয়ে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে এই বিষয়ে পরামর্শ করে।গভীর রাতে তাদের গোত্রের একজন মদ্যপ অবস্থায় আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার বাবার নাম ধরে গালাগাল করে। আমরা নীরবে এমন গালাগাল শুনে বড় হয়েছি। অথচ তাদের সঙ্গে আমরা কখনো কোন বিষয়ে কোন দিন আগ বাড়িয়ে কোন দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছি বলে কখনো মনে পড়েনা।কিন্তু নীরবে তাদের এমন অত্যাচার সহ্য করে সেই একই বশত ভিটায় বশত করেছি।এদের মত মানুষদের প্রতিবাদ করতে গেলে রক্তপাত করার মত  শক্তি ও সাহস দরকার, সেই সাথে দরকার তাদের মতো করে গালাগালের নোংরা ভাষায় কথার উত্তর দেবার মানুসিকতা।যা আমাদের ছিলোনা বলেই তারা এমন অত্যাচার চালিয়েছে ধারাবাহিক ভাবে। 


মনে করেছিলাম সময়ের ব্যবধানে তাদের মানুসিকতার পরিবর্তন হয়েছে, কারণ ঐ বর্বর গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেছে,কেউ ন্যায় অন্যায় পথে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করেছে,ফলে সমাজের সভ্য মানুষদের সাথে ঐ গোষ্ঠীর কেউ কেউ উঠা বসা করে।সময়ের ব্যবধানে আমাদের মনের পুরনো ক্ষত কিছুটা আরোগ্য হয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।ফলে শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপনও করছি দীর্ঘদিন ধরে।  


দাদা দাদীর কবর এই পৈতিক ভিটায়।অনেকবার এই ভিটা ছেড়ে অন্যত্র বসবাসের উদ্যোগ নেয়া হলেও স্থানীয় মানুষ ও কবরের মায়ায় আর যাওয়া হয়নি। আমি দেশের বাইরে পরিবার নিয়ে স্থায়ী ভাবে থিতু, দেশে গেলে সর্বোচ্চ এক মাস থাকা হয়, বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে।শুধু বাবা মার এই বশত ভিটায় দিনাতিপাত।সারাজীবনের মায়া মমতায় ঘেরা বাড়ীটি ছেড়ে আমারও কোথাও বাড়ী করার ইচ্ছে ভেতরে কাজ করেনা। যেখানেই থাকি, দাদা দাদীর কবরের এই ভিটেকে শেষ আশ্রয়স্থল মনে হয়।আমার সন্তান যদি বড় হয়ে একদিন তার বংশের ঠিকানা খুঁজে তাহলে কোথায় যাবে?এছাড়া,বাবা মা জীবনের শেষ দিনগুলো যাতে  সুন্দরভাবে কাটাতে পারে,ইত্যাদি ভেবে এই ভিটে মাটিতে ছোট্ট এক একতলার একটি পাকা ঘর করা হয়েছে একজন স্থপতির নক্সায়।

করোনার কারণে প্রায় দুই বছর দেশে যাওয়া হয়না। দুই মাসের কাছাকাছি সময় হাতে নিয়ে এবার এই সংক্রমণের মধ্যেই অনেক নিয়মকানুনের বেড়াজাল অতিক্রম করে দেশে যাই পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতে।লক ডাউনের কারণে এলাকা বন্দী হওয়ায় নিজের মতো করে বাড়ীঘর সাজানোর কাজে মনোনিবেশ করি।ঘরের সামনে ফুলের বাগান, বাড়ীর প্রবেশদ্বার থেকে ঘরের প্রবেশমুখ পর্যন্ত লাল টালির রাস্তা, রাস্তার দুই ধার দিয়ে নানা রকমের পাতাবাহারের গাছ রোপণ, ইত্যাদি কাজ বাবা ও ভাগ্নেকে সঙ্গে করে করেছেি।মনে হল,বাবা মার বয়স হয়েছে, তার উপর বাড়ীতে আমাদের ভাইবোন কেউ থাকে না।চারপাশে পরিপূর্ণ ইটের প্রাচীর দিয়ে দিলে বাড়ীর নিরাপত্তা বাড়বে এবং তাদের জীবনযাপন আরও নিরাপদ হবে।

আমার এক চাচা কনস্ট্রাকশন কাজের ঠিকাদারি করেন। আব্বাকে দিয়ে ওনাকে বাড়ীতে ডেকে আনলাম প্রাচীর নির্মাণের পরামর্শের জন্য। কিভাবে প্রাচীর নির্মাণ হবে এবং কত টাকা খরচ হবে এই কাজ শেষ করতে, চাচা বিস্তারিত জানালো। আলোচনা শেষে কাজের দায়িত্ব চাচার উপর অর্পণ করা হল।চাচা তার গ্রুপ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। বাড়ীর সামনের প্রাচীর শেষ করে যেদিন আমাদের পূর্বের শত্রু সীমানায় কাজ শুরু করতে গেলেন, সে দিন বাধল যত বিপত্তি। যা আমাদের ধারণা ছিলোনা। আমার জমিনে আমি প্রাচীর নির্মাণ করবো তাতে চিন্তা ভাবনার কি আছে।যে সীমানার উপর দিয়ে টিনের বেড়া রয়েছে শুধু তা সরিয়ে ঐ একই সীমানায় উপর ইটের প্রাচীর নির্মাণ হবে। তাছাড়া সীমানা সমস্যার সমাধান হয়েছে সেই ত্রিশ বছর পূর্বে। তাই সরল মনেই কাজ করতে গিয়েছি আমরা।ভাবনার ত্রিশ বছর যে আমরা ভ্রান্তির উপর কাটিয়েছি, তা কখনো বুঝতে পারিনি। আমার চাচা সরল ভাবনায় তার দল নিয়ে কাজ শুরু করতে গেলেন।টিনের বেড়া সরিয়ে সীমানা পিলার ধরে রশি টেনে যখন তার কার্যক্রম শুরু করতে গেলেন তখন আমাদের দীর্ঘদিন ধরে গালাগাল করা সেই মদ্যপ তার গোত্রের লোকজন নিয়ে এসে হাজির হলেন এবং দাবী তুললেন, যেহেতু এখানে স্থায়ী প্রাচীর নির্মাণ হবে সেহেতু মূল সীমানা থেকে দুই হাত জমি ছেড়ে দিয়ে প্রাচীর করতে হবে।কারণ, এখান দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে পৌরসভার রাস্তা নির্মাণ হবে।এই অযৌক্তিক দাবীর কারণে উভয় পক্ষের তর্কাতর্কিতে এলাকার লোকজন ও স্থানীয় পৌর কমিশনার এসে হাজির হলেন।তাদের মধ্যস্থতায় প্রাচীর নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখা হল। এর মধ্যে তাদের এই অনৈতিক দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য চলতে লাগলো তাদের গোত্রের ঐক্যবদ্ধ যাবতীয় কূটকৌশল।এলাকার মানুষের মধ্যে আমাদের সম্পর্কে বানোয়াট নানা নেতিবাচক কথাবার্তা বলে তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে লাগলো।এলাকার মানুষ আমাদেরকে ভালো জানলেও আমাদের পক্ষে এসে কথা বলতে ভয় পায়।যদি এই আদিম অসভ্য গোত্র দ্বারা তারা পরবর্তীতে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা ওদেরকে পেছন থেকে গালি দেয়,ঘৃণা প্রকাশ করে কিন্তু সামনে এসে কখনো ওদের অন্যায়ের কোন প্রকার প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে না ওদের বর্বরতার ভয়ে। 


 এই সীমানা প্রাচীর নির্মাণ দ্বন্দ্বের ঘটনা চলে গেলো আমাদের স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান পর্যন্ত।পরবর্তীতে রূপ নিলো রাজনীতিতে,ঐ গোত্রের লোকজন জেলার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে এলাকার কূটরাজনীতি পরিচালনা করে থাকে।আমার পরিবারের আমি ছাড়া কেউ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলনা এবং এখনো নেই।আমার সেই ছাত্রজীবনে বাম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলও এখন বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক সংগঠন সঙ্গে কোন প্রকার সংযোগ নেই।আমার বাবার দাঁড়ি টুপি এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াকে ইস্যু বানিয়ে সেই মদ্যপ প্রচার করতে লাগলো আমার বাবা জামাত ইসলামের রাজনীতি করে।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য বেশ কয়েকবার লোকজন নিয়ে বসা হল।পরিশেষে পৌরসভার ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য লোকের উপস্থিতিতে আমাদের প্রায় দেড় হাত জমি ছেড়ে দিয়ে প্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত দেয়া হল। অথচ এখান দিয়ে যে রাস্তা নির্মাণ হবে তার কোন সিদ্ধান্ত দূরে থাক আলোচনাই হয়নি পৌরসভায়। অন্যদিকে, আমার আইনগত বৈধ জায়গা আমি না ছেড়ে দিলে পৌরসভার কোন বিশেষ আইন নেই জোর করে নেবার। কিন্তু আমরা যদি এই সিদ্ধান্ত না মেনে আইনের আশ্রয় নিয়ে আমাদের জায়গায় প্রাচীর নির্মাণ করতে যাই তাহলে পরবর্তীতে হানাহানির সৃষ্টি হবে। আমি দেশের বাইরে থাকি,ফলে আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাবা মাকে ঐ আদিম অসভ্য গোত্রের লোকজন ভয়ভীতির মধ্যে রাখবে।অনেক অজানা আশঙ্কার কথা চিন্তা করে নিজের আইনগত অধিকারের জায়গা ছেড়ে দিয়ে প্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেই। 


যদি আমরা অন্যের মাথায় আঘাত করা এবং অন্যকে অসভ্য ভাষায় গালি দেবার মানসিকতা লালন ও  শক্তি ধারণ করতাম তবে এই অনৈতিক দাবী উত্থাপিত হতো না কখনো এবং এমন সিদ্ধান্তের কাছে মাথা নত করতামনা।অথবা,আমার বাবা যদি সেই ত্রিশ বছর পূর্বে ওদেরকে সভ্য মানুষ না ভেবে সমাধান হওয়া বিতর্কিত সীমানায় ইটের প্রাচীর নির্মাণ করে দিতো তাহলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতোনা।


এমতাবস্থায়, আমরা যদি এই এলাকার হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ হতাম তাহলে হয়তো বশত ভিটা বিক্রি করে ভারতে চলে যেতাম।কিংবা সংখ্যালঘু অত্যাচারের অভিযোগ এনে কোন মানবাধিকার সংস্থার সহায়তা চাইতাম।সাধারণত আমাদের দেশে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ যা করে থাকে। কিন্তু এসবের কোন সুযোগ ছিলোনা, কারণ ধর্মীয় পরিচয়ে আমরা উভয় পক্ষই ছিলাম মুসলিম ধর্মাবলম্বী। আমরা মুসলিম হলেও তারা ধর্মীয় সমগোত্রীয় ভেবে কখন আমাদের পরিবারকে অত্যাচার ও অসম্মান করতে এতোটুকু ছাড় দেয়নি। কারণ এখানে ধর্মের চাইতে বড় ছিল ব্যক্তি স্বার্থ এবং পেশী শক্তির ব্যবধান।এখানে ধর্মীয় গোত্র পরিচয় পারস্পরিক শান্তির সহবস্থানে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি।দেশে অন্য ধর্মের নির্যাতিত মানুষ তাদের অভিযোগ বিভিন্ন সংগঠনের নিকট তুলে ধরতে পারে,কিন্তু  আমরা মুসলিম হওয়ায় আমাদের অসহায়ত্ব কোথায়ও তুলে ধরতে পারিনি।  


আরও পরিষ্কার করার জন্য জীবনের বাস্তব আরও একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই, আমার শিক্ষা জীবনের বড় একটা সময় পার হয়েছে রাজবাড়ী সরকারি কলেজে।সারা দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে যখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল,আওয়ামী ছাত্রলীগ ও ইসলামি ছাত্র শিবিরের আধিপত্য তখন আমাদের ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর।এই আধিপত্যের মূলে ছিল,জেলার বাম রাজনৈতিক আন্দোলনের শক্তিশালী অবস্থান এবং ওয়ার্কার্স পার্টি মনোনীত প্রার্থীর দীর্ঘ পনেরো বছরের রাজবাড়ী পৌরসভার চেয়ারম্যানের ক্ষমতা।জেলার দুই সংসদীয় আসন থেকে অনন্যা দলের এম পি নির্বাচিত হলেও জেলার হৃদপিণ্ড পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতো বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে।দেশের ক্ষমতা যার হাতেই থাকুক না কেন জেলা শহরের নিয়ন্ত্রণ ছিল বামদের হাতে।শক্তিশালী কর্মীবাহিনীর কারণে এই ছোট্ট শহরের মধ্যে অন্য দলের জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করার মত সময় বাম নেতাদের হাতে ছিল না।বামদের কর্তৃত্বের কারণে শহরের শান্তি শৃঙ্খলা ছিল কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।কিন্তু শক্তি ও ক্ষমতা হাতে থাকলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ যেমন হয়ে থাকে রাজবাড়ীর স্থানীয় ওয়ার্কার্স পার্টি ও ছাত্র মৈত্রীর নেতাদের আচরণ শতভাগ অন্যদের মত না হলেও অন্যের উপর কর্তৃত্ব ও প্রভার বিস্তারের ক্ষেত্রটা ছিল শতভাগ।রাজবাড়ী সরকারী কলেজের ছাত্র সংসদ আশি ও নব্বই দশক ছিল ছাত্র মৈত্রীর দখলে।স্বভাবতই কলেজ ক্যাম্পাসে অনন্যাও ছাত্র সংগঠনের অবস্থান ছিল বিলের ছোট মাছের মত। সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের ক্যাম্পাসে ছাত্র মৈত্রীর নেতাদেরকে একটু সমীহ করেই চলতে হতো। বিশেষ করে অন্য জেলা থেকে আসা শহরের মেস ও কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা ছাত্রদের।আমাদের সময়,২০০০ সালের দিকে জেলা ছাত্র মৈত্রীর নেতৃত্ব যার হাতে ছিল তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে ছিল হিন্দু ধর্মাম্বলি।দলের আর একজনের হাতে দলের নেতৃত্বর গুরুত্বপূর্ণ পদ না থাকলেও রাজনৈতিক সংঘর্ষে অগ্রভাগে থাকার কারণে দলীয় নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। ফলে কলেজ ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের আসে পাশের এলাকার ছাত্ররা তাকে সমীহ করে চলতো। এই ছাত্র নেতাও ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। ক্যাম্পাসে কি হবে এই দুই ছাত্রনেতা যে সিদ্ধান্ত নিতো তাই হতো। যদি কোন ছাত্রকে এদের কেউ বলতো তোমাকে আজ ছাত্র মৈত্রীর মিছিল করতে হবে সেই ছাত্রকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিল করতে হতো। কখনো ক্যাম্পাসে ছাত্র মৈত্রীর মিছিল বড় করার জন্য কলেজ হোস্টেল থেকে ছাত্রদের ডেকে আনা হতো, যদি কেউ আসতে রাজী না হতো তখন যদি ঐ দুই ছাত্র নেতার নাম উল্লেখ করে বলা হতো  দাদা যেতে বলেছে, তখন অনেক দাড়ি টুপিওয়ালা ছাত্রও ভয়ে পড়ার টেবিল ছেড়ে এসে ছাত্র মৈত্রীর মিছিলে যোগ দিতো। ঐ দাঁড়ি টুপিওয়ালা ছাত্র কখনো বলতো না, আমি মুসলমান, হিন্দু ছাত্রনেতার ডাকে মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য নই।ঐ সময় এমন কথা বলে কারো ক্যাম্পাসে অবস্থান করা সম্ভব ছিল কারণ তাদের কথার অবাধ্য হলে তাকে সমস্যায় পরার সম্ভাবনা ছিল।এই প্রভাবশালী দুই ছাত্র নেতার কর্তৃত্বে তাদের ধর্মীয় পরিচয় কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাদের এই প্রভাবের মূলে ছিল তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তারা কখনো অন্যের উপর প্রভাব সৃষ্টিতে ভীত ছিলেন না।বরং,তাদের শত শত অনুসারী ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম ছিলেন, যারা তাদের নেতৃত্বে অন্য সংগঠনের মুসলিম ছাত্রদের ক্যাম্পাসে দমিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে। এখানে নেতার ধর্মীয় পরিচয় কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।    


অন্যের উপর শক্তি প্রদর্শন বা প্রভাব বিস্তার যদি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর নির্ভর করতো তবে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে সুব্রত বাইন,বিকাশের মত শীর্ষ সন্ত্রাসী সৃষ্টি হতো না, আর ভারতের মত বিশাল হিন্দু জনবহুল দেশের মধ্য থেকে সৃষ্টি হতোনা দাউদ ইব্রাহিম মত অপরাধ জগতের শিরোমণির। 

 


আমাদের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সৃষ্টির  মূলে থাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি।একমাত্র ধর্মকে ব্যবহার করেই অপরাজনীতির মূল উদ্দেশ্য সবসময় শতভাগ সফল হয়েছে।   


বাংলাদেশে হিন্দু,বৌদ্ধ,,খ্রিষ্টান সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর উপর জুলুম নির্যাতনের ঘটনা ধারাবাহিক।হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা উদ্বেগজনক ছিল ২০২১ সালে। একই বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০৪টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮৪টি বাড়িঘর ও ৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই হামলার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৩০০ জন আহত হয়। এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। 


একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের দরং জেলায় একটি সুবিশাল শিবমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।আশ্রয়চ্যুতরা প্রতিবাদ স্বরূপ বিক্ষোভ করলে সেই বিক্ষোভ মিছিলে চলে পুলিশ গুলি।এতে দুই ব্যক্তির মৃত্যু সহ কয়েকজন আহত হয়।  


 এই ঘটনাগুলোর ভিডিও চিত্র যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা দেখেছি তখন প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের হৃদয় শিউরে উঠেছে।আমরা দেখেছি এই ভয়াবহ নৃশংসতার যারা স্বীকার হয়েছে তারা সবাই সমাজের নিরন্ন শ্রেণীর মানুষ। যাদের একটি ধর্মীয় পরিচয় থাকলেও তাদের জীবনের মূল যুদ্ধটা জীবন ও জীবীকার সঙ্গে।বংশপরম্পরায় ধর্মীয় পরিচয় বহন ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করে আসলেও এরা কেউ ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন বোদ্ধা শ্রেণী বা ধর্মীয় নেতৃত্ব শ্রেণীর মানুষ নয়।কোন ধর্মীয় গোত্রের মানুষের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করার মত আর্থিক ও রাজনৈতিক ভাবে শক্তি সামর্থ্যযোগ্য মানুষও তারা নয়। এরা সরল ধর্ম বিশ্বাসের আবেগি মানুষ।অথচ,কখন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে,কখনো ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই নিরন্ন শ্রেণীর ধর্ম বিশ্বাসী মানুষেরদেরকেই প্রতিশোধ বা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। এক শ্রেণীর উগ্র ধর্মান্ধদের উস্কে দিয়ে এই নিরন্ন মানুষদের উপর চালনা হয় মধ্যযুগীয় বর্বরতা।মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া হয় তিলে তিলে গড়া ঘরবাড়ী,বিশ্বাস ও ভালোবাসার উপাসনালয়, নির্যাতন চালানো হয় শিশু ও নারীদের উপর, লুট করা হয় ঘরে রাখা কষ্টার্জিত সঞ্চয়। 


এই বর্বর হামলাগুলোর যারা ধারাবাহিক ভুক্তভোগী তাদের অধিকাংশই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ,যাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে নিরীহ প্রকৃতির।প্রতিটি সহিংসতা সৃষ্টির পূর্বে খুব ঠাণ্ডা মাথায় কুচক্রীরা এই শ্রেণীর মানুষদেরকেই বেছে নেয়া হয় বলির পাঠা হিসেবে, কারণ এই নিরন্ন শ্রেণীর মানুষদের ঘটনা পরবর্তীকালে কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও মাথায় হাত বুলিয়ে  সান্ত্বনার বানী শুনিয়ে দিলেই এরা সহজেই ভুলে যায় নিজের উপর হওয়া সকল অবিচার।জীবন ও জীবীকার সঙ্গে যাদের নিত্য যুদ্ধ তাদের হায়েনাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করার শক্তি,সাহস ও অর্থ আসবে কোথা থেকে। তাইতো যুগের পর যুগ এই অন্যায়ের সাথে বার বার আপোষ করে এদের মাতৃভূমির বুকে বসবাস। নিজ ভূমিতে  অবস্থান করেও বাস্তুহারা মানুষের মতই জীবনের অনুভূতি।  


প্রশ্ন জাগে, ধর্মই যদি সহিংসতার মূল কারণ বা ধর্মীয় পরিচয় যদি আক্রমণের লক্ষবস্তু হয় তবে ধর্মের মান রক্ষার নামে শুধু এই নিরন্ন শ্রেণীর মানুষদেরকেই কেন বেছে নেয়া হয় জুলুম করার জন্য,সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষদের কেন বেছে নেয়া হয়না। আমরা কখনো দেখিনা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নামে বাংলাদেশের কোন হিন্দু সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা বা আমলার বাড়ীতে হামলা হয়েছে, অথবা কোন হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান বা উপজাতীয় ধনী ব্যবসায়ীর বাড়ীতে হামলা হয়েছে, ধর্মীয় সংগঠনের কোন নেতার বাড়ীতে হামলা হয়েছে।

অপরদিকে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন  সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নামে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন চলে তখন দেখা যায় না কোন উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী চিত্রনায়ক শাহরুখ খান,সালমান খান বা আমীর খানের বাড়ীতে ধর্ম অবমাননার প্রতিশোধ নিতে আক্রমণ করেছে।এদের উপর আক্রমণের না হওয়ার কারণ, এই শ্রেণীর মানুষের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন, এদেরকে নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রশক্তি সরাসরি এদের পাশে থাকে ,সেই সাথে ক্ষমতা বা অর্থের প্রভাবের কারণে এদের মিত্রতা গড়ে সমাজের অন্য প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গে।সুতরাং এদের আঘাত করতে গেলে উল্টো আঘাতের শিকার হতে হবে।যেহেতু ধর্মকে মাধ্যম করে রাজনীতি তাই শক্তিশালী মানুষের উপর আঘাত করে মূল উদ্দেশ্য ব্যহত করা তাদের কৌশলেরই অংশ নয়।       


দেশে যখন এমন সহিংসতা শুরু হয় তখন দেখা যায় দুই একটি ঘটনার পর পরই দেশের সরকারি দল,বিরোধী,রাষ্ট্রীয় প্রশাসন মিডিয়া বিবৃতির মাধ্যমে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।দেশের সর্বোচ্চ তিন শক্তি একত্রিত হওয়ার পরও এই তাণ্ডব লীলা চলতেই থাকে।আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত রাষ্ট্রীয় কোন ইস্যুতে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের ঐক্যসুরে প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায় না।প্রশ্ন জাগে,জনগণের স্বার্থে সার্বক্ষণিক মাঠে থাকা দেশের সর্বোচ্চ তিন শক্তি সামনে কিভাবে এই বর্বরতা ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকে। (যারা জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনীতি করেন,যারা জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন গ্রহণ করেন)। তাহলে দেশের এই তিন শক্তির চেয়েও কি সন্ত্রাসীরা বেশী শক্তিশালী? এদের সবার অবস্থান যদি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হয়, তবে কেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সময় স্থানীয় সরকারী ও বিরোধীদলের কর্মীরা একত্রিত হয়ে নির্যাতিত মানুষদের জানমাল রক্ষা করতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে না? শুধু বক্তৃতা করে একে অপরকে দোষারোপ করে। যাদের ওয়ার্ড পর্যায়ের কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময় মুহূর্তেই শত শত কর্মী জড়ো হয়ে যায়।অথচ, চোখের সামনে এমন হিংস্র কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় কোন প্রতিরোধ ছাড়াই !যে দেশে কারো কথায় বা লেখায় কোন বিশেষ মানুষের বিন্দু পরিমাণ মান ক্ষুণ্ণ হলে প্রশাসন মুহূর্তের মধ্যেই ঐ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার জেলে পুরে দেয়, সেই প্রশাসনের সামনে কি করে একের পর এক  নিরন্ন মানুষের বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ হয়, লুণ্ঠন হয়?  

তাহলে এই শক্তিশালী সন্ত্রাসীদের আসল পরিচয় কি? কারা এদের পৃষ্ঠপোষক?


রাজনীতি একটি দেশের মানুষের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন  করে। অপরদিকে সমাজের অস্থিতিশীলতার জন্য অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অপরাজনীতি।যা আমাদের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী চর্চা হয়। যার ভুক্তভোগী সবচেয়ে সমাজের নিরন্ন শ্রেণীর মানুষ। এই শ্রেণীর মানুষকে অত্যাচার যেমন অপরাজনীতির একটা অংশ, আবার এদের পাশে দাঁড়িয়ে যে সেবা শুশ্রূষা দেবার দৃশ্য দেখি সেটাও অপরাজনীতিরই  অংশ। এই দুটি কাজই করা হয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থে। 

এই ক্ষেত্রে নিজের দেখা এক বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প তুলে ধরে স্পষ্ট করি, আমাদের সময়ে আমার কলেজ ক্যাম্পাসে তিনটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড সক্রিয় ছিল।এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল একটি বাম ছাত্র সংগঠন।এরাই ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করতো। অপর দুটি দেশের সরকারি ও প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন।আমি নিজেও বাম ছাত্র সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম।একদিন আমার দলের একজন বড় ছাত্রনেতা একান্তে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দুই ক্যাডারকে ডেকে তখনকার দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের এক ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলে খেপিয়ে তুললেন।এর পাঁচ মিনিট পর ঐ দুই ক্যাডার ক্যাম্পাসের সকল ছাত্রছাত্রীদের সামনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐ ছাত্রনেতাকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলেন।এই হামলার মাঝে গিয়ে হাজির হলেন ক্যাম্পাসের সম্মানিত ঐ বাম বড় ছাত্রনেতা,হামলা চলাকালে তিনি আহত ছাত্রনেতাটিকে বুকে আগলে ধরলেন।ঐ দুই ক্যাডারকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন ঘটনাস্থল থেকে।পরে ঐ রক্তাক্ত ছাত্রনেতাকে তিনিই দ্রুত একটি রিক্সায় তুলে নিয়ে গেলেন জেলা সদর হসপিটালে। 

এই নিন্দনীয় ঘটনার জন্য সবাই দোষী সাব্যস্ত করলেন সরকারি দলের দুই ক্যাডারকে।সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দৃশ্যমান মূল্যায়ন থেকে মহৎ মানুষ হিসেবে প্রশংসা ভাসিয়ে দেয়া হলো বাম ছাত্রনেতাটিকে তার এমন বীরত্ব দেখানোর জন্য। কিন্তু এই ঘটনামূলের আসল নায়ক যে এই মহৎ মানুষটি সে কথা আমরা হাতে গোনা দুই একজন ছাড়া কেউ জানেনা।

তাই দৃশ্যমান চোখ দিয়ে দেখে আমরা যা মূল্যায়ন করি তার প্রকৃত সত্যতা নিয়ে কজনইবা ভাবী।এখানে যে দুজন ক্যাডার এই নৃশংস ঘটনা ঘটালেন তারা মূলত শরীর সর্বস্ব জ্ঞানহীন মানুষ, মস্তিষ্ক সর্বস্ব মানবিক মানুষ নয় বিধায় কোন প্রকার ভাবনার সময় না নিয়েই অন্যের উস্কানিতে মুহূর্তের মধ্যে এমন একটি পাশবিক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো।ওদের এই জ্ঞানহীনতার কারণেই অতি সহজে অন্যের স্বার্থে ওরা ব্যবহার হয়েছে। অন্যের ক্ষতি ও নিজের ক্ষতির চিন্তা মাথায় আনেনি। 

সরল মনে রাজনীতিতে এসে এই ঘটনার পর মনে হয়েছিলো ক্যাম্পাস রাজনীতি এমন, তাহলে আমাদের জাতীয় রাজনীতির অবস্থা কেমন? এরপর ভবিষ্যৎ সক্রিয় রাজনীতির উপর আর আগ্রহ তৈরি হয়নি। 


নিরন্ন মানুষের চোখের জলই আমাদের দেশের রাজনীতির মূলধন ,অনেকের রুটি রুজির অবলম্বন। 

অন্যের ক্ষতিসাধন করে নিজের উন্নতি সাধনের রাজনীতির ধারা আজ আমাদের রক্তগত। 


আমাদের অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ধার্মিক নয়, অধিকাংশ মানুষই আবেগী অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। তাই এদের চিন্তাশক্তি ও ধৈর্য ধারণ ক্ষমতা কম। এদেরকে খেপিয়ে তোলা সহজ। ক্যাম্পাসের ঐ বাম ছাত্র নেতার মত আমাদের সমাজের চতুর ও টাঊট প্রকৃতির মানুষেরা ধর্মকে ইস্যু বানিয়ে সহজেই এদেরকে দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।আর এই নির্বুদ্ধিতার কারণে এক আবেগী অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ অন্য আবেগী অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ উপর আক্রমণ করে বসে।এদেরকে সঠিক পথ দেখানো দেশের রাজনীতিবিদের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সমাজে হয় তার উল্টো। 


ধর্ম দ্বারা মানুষকে বিভাজনের মাধ্যমে ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের চোখের জল দেখে নীরব থাকা একজন মনুষ্যহৃদয় বিবর্জিত মানুষের পরিচয়।  


বাংলাদেশে হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। যাদের কাজ এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ যখন বাংলাদেশে কারো দ্বারা আক্রান্ত বা আঘাত প্রাপ্ত হবে তখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা,সরকারের নিকট প্রতিবাদলিপি পেশ করা,নানা দেশে সভা সমিতি করে অন্যদেশের নিকট এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষকে অসহায় ও অত্যাচারিত হিসেবে উপস্থাপন মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারকে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা। অর্থাৎ ,এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য হল তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা।এই সংগঠনের অনুকম্পা পেতে হলে অবশ্যই এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কেউ হতে হবে, তা নাহলে আপনি যতই অত্যাচারিত মানুষ হোন না কেন এই সংগঠন আপনার পক্ষে কোন কথা বলবে না। আপনার জন্য প্রতিবাদ করবে না। এখানে আপনার প্রথমত ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য।সেই সূত্র ধরে বলা যায় এটি একটি কট্টর ধর্ম ভিত্তিক সংগঠন বা মৌলবাদী সংগঠন।কারণ কোন নির্যাতিত মানুষের ধর্মীয় পরিচয় যদি হয় মুসলিম তাহলে সেই ব্যক্তির অসহায়ত্ব তাদের চিন্তার কোন বিষয় নয়।এই থেকে প্রমাণ হয় সংগঠনটি রাষ্ট্রের নিপীড়িত মানুষের পক্ষের সংগঠন নয়। সংগঠনটিকে সার্বজনীন ধর্মীয় সংগঠনও বলা যায় না কারণ সংগঠনটির সঙ্গে  দেশের সকল ধর্ম বিশ্বাসের মানুষের সম্পৃক্ততা নেই।বিশেষ তিনটি ধর্মের ঐক্যের সংগঠন।প্রশ্ন উঠতে পারে তাদের ঐক্য কাদের প্রতিপক্ষ করে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে, নাকি ধর্মের নামে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।যেহেতু এদের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা নেই তাই ধরে নিতে হবে তাদের এই ঐক্য দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রতিপক্ষ করে সৃষ্ট।তাহলে যৌক্তিক ভাবে বলা যায়, এই ঐক্য দেশের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টিতে ভূমিকার পরিবর্তে বরং ধর্মীয় এক সীমারেখা সৃষ্টিতে অবদান রেখে চলছে।ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ সবস্থানের গুরুত্বের চেয়ে গোত্রের আধিপত্য রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করা এই জাতীয় ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে মুখ্য।যা একটি সভ্য জাতি ও দেশ গঠনের অন্তরায়। 


তেমনি ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে দেশে যেসব ধর্মভিত্তিক ইসলামি সংগঠনগুলো রয়েছে তারাও এই সংকীর্ণতার অধীন। 

 

ধর্মীয় গোত্রের ঐক্যের দ্বারা একটি সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে যদি সত্যি সমাজের নিপীড়িত মানুষকে রক্ষার অভিপ্রায় থাকে তবে সেই সংগঠনের প্রথম কাজ হল দেশের প্রতিটি ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

অথবা নির্যাতিত যে কোন ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা।  


আমাদের উপমহাদেশে যখন কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর হয় তখন যতটুকু প্রতিবাদ দেখা যায় তা আশাব্যঞ্জক নয়।দেশে আমরা যাদেরকে জাতির বিবেক বলে সম্মান করি, অনুসরণ করি, তাদেরও কোন জোরালো প্রতিবাদ বিশেষ ভাবে  চোখে পড়ে না,সরকারের স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে।অনেক সাম্প্রদায়িক মানুষ রয়েছে যারা এমন সহিংসতায় অংশগ্রহণ না করলেও অন্য ধর্মের মানুষের উপর হামলা হয়েছে ভেবে নীরবে বন্য আনন্দে মেতে ওঠেন।একমাত্র নিজ ধর্মের মানুষের উপর হামলা হলে প্রতিবাদ মুখর হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।এই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়।এদের উদ্দেশ্যে বলা যায়ঃ  

নিজ ধর্মের মানুষ হত্যায় 

প্রতিবাদে ফাটি। 

অন্য ধর্মের মানুষ হত্যায় 

মনে মনে হাসি। 

চুপচাপ আমিও যে 

ধর্মীয় সন্ত্রাসী, 

সে কথা কখনো কি একবারও ভাবি ?  


এমন ধর্মীয় সন্ত্রাসী মানসিকতা পোষণকারী মানুষগুলোও সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে হুমকি স্বরূপ।আমরা ৪৭, ৭১ পেরিয়ে এখন অনেক দূরে কিন্তু এখনো যদি মানসিকতায় সাম্প্রদায়িকতা লালন করি তাহলে আমাদের এত বছরের পরিবর্তনটা কোথায়? আমাদের সমাজের একশ্রেণীর নিম্নস্তরের এমন মানসিকতাসম্পন্ন  মানুষদের কারণেই সমাজ বিরোধী চক্র আমাদের মাঝে বিভাজনের আগুন জ্বালাতে সুবিধা পায়।যখন দেশে কোন মানবতা বিরোধী ঘটনা ঘটবে তখন একজন মানবিক মানুষ হিসেবে প্রথমে  অমানবিকতাকে অমানবিক হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে এবং নিজস্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করার অভ্যাস গড়ে তোলাও জরুরী।যদি ভাবি আক্রান্ত মানুষগুলোর ধর্ম পরিচয় কি?যদি আমার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ না হয় তবে কেন আমি প্রতিবাদ করবো, তবে আমি যত ধর্মকর্মই করি আর ব্যক্তি জীবনে যতই সৎ মানুষ হই না কেন, নিজেকে মানবিক মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারি কি?শোষিতের চোখের জল যদি নিজের হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি না করে তবে নিজেকে মানুষ দাবি করি কোন যুক্তিতে।


ধর্ম রক্ষা বা ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার নাম করে আমরা যখন অন্যের দিকে ছুরি হাতে তেরে যেতে উদ্যত হই তখন মনুষ্য হৃদয়ের দুয়ার একটু খুলে কি ভাবতে পারিনা, যার বুকে ছুরি চালিয়ে আমার স্রস্টাকে খুশী করে পরপারের সুখী জীবন পাওয়ার আশা করছি সেই মানুষটি কার সৃষ্টি।প্রত্যেক স্রস্টা বিশ্বাসকারী এক বাক্যে স্বীকার করবেন স্রস্টার সৃষ্টি।সেই লোক আপনার পথে স্রস্টার আরাধনা না করলেও তার আলো বাতাস যদি আপনার স্রস্টা বন্ধ না করে তবে কেন আপনার এতো তাড়া তার প্রাণবায়ু কেড়ে নেয়ার।যে মানুষ স্রস্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে স্রস্টাকেই ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করে সেই মানুষটার বেঁচে থাকার জীবন উপকরণ থেকে আপনার স্রস্টা বঞ্চিত করেন না।আপনি যাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশক্তিময় হিসেবে মানেন,সেই শক্তিময়ের যদি এতো ক্ষমা এবং ধৈর্য তবে তার ক্ষুদ্র সৃষ্টি হয়ে আপনার কেন এতো অধৈর্য। স্রস্টার সৃষ্টির ক্ষতিসাধন করে স্রস্টার আনুগত্যের আশা করা পৃথিবীর সর্বোচ্চ মূর্খ ধারনা নয় কি! 

আমাদের প্রত্যেকের নিজের কাছে নিজের বিশ্বাসের ধর্ম শ্রেষ্ঠ।সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে স্রস্টার সৃষ্টিকে  ভালোবেসে।ধর্ম রক্ষার নামে মানুষের রক্তে হাত রাঙ্গিয়ে নয়।   

যদি কোন বিশ্বাস বা আদর্শ অনুসরণের ফলে আপনার মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, হিংস্রতা এবং শ্রেণী বৈষম্য মানসিকতার উদয় ঘটায়, তাহলে বুঝতে হবে আপনি হয়তো আপনার ধারণকৃত বিশ্বাস বা আদর্শের বিধিবিধানের গভীরে যেতে পারেননি, নতুবা আপনি ভ্রান্ত আদর্শ বা বিশ্বাসের মায়াজালে অন্ধ হয়ে আছেন, যা বর্জন করাই শ্রেয়।

আমার ধর্ম আমার কাছে, আপনার ধর্ম আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ হয়েই থাক,যার যার পরপারের সুখী জীবন পাওয়ার রাস্তা যার যার মত সঠিক হয়েই থাক, কিন্তু পার্থিব লোকারণ্যের পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন মত পথের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি এক স্রস্টার সৃষ্টি ভেবে প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার একটি ক্ষুদ্র স্থান  অন্তরের এককোণে সৃষ্টি করতে পারি তবেই এই পৃথিবীটা আমার আপনার দ্বারা পরিণত হবে এক শান্তির স্বর্গোদ্যানে।   


মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)

প্যারিস,ফ্রান্স