বাংলাদেশে
এখন নিয়মিত বিরতিতে নাস্তিক খুন হচ্ছে,আস্তিক খুন হচ্ছে,উধাও হয়ে যাচ্ছে রাজনীতির রথী মহারথীরাও।এক একটি খুনের সাথে সাথে সরগরম হয়ে উঠছে ফেজবুকের পাতা,টিভি টকশোর টেবিল, মিছিল শ্লোগানে প্রকম্পিত রাজপথ,মানবাধিকার কর্মীর মানবতার পালে লাগছে ঝড়ো হাওয়া।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ আজ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হতে শুরু করেছে।প্রশ্ন,তাহলে কেন হত্যার মিছিল দিন দিন ভারী হচ্ছে ?
বাংলাদেশে আজ মধ্যেপ্রাচ্যের ন্যায় সম্মুখ সসস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত না হলেও ইতোমধ্যে নীরব গোত্রীয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।উপরে উপরে আমরা হত্যার বিরুদ্ধে কথা বললেও মূলত বিভিন্ন যুক্তিতে হত্যাকাণ্ডকেই কখনো প্রতক্ষ্য ভাবে কখনো মৌন সমর্থন দিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছি।কারণ, দেশের সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আমরাদের উপর আজ নানামূখী মতাদর্শ কট্টরভাবে চাপিয়ে দিয়ে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছে।তাই আজ কোন নাস্তিক্যবাদী চিন্তার মানুষ খুন হলে আস্তিক্যবাদী ভেতরে ভেতরে জয় উল্লাশ করছে, আবার আস্তিক্যবাদী চিন্তার মানুষ খুন হলে নাস্তিক্যবাদী ভেতরে ভেতরে জয় উল্লাশ করছে। জামাত শিবির বা হেফাজত ইসলাম খুন হলে গণজাগরণ মঞ্চ জয় উল্লাস করছে , আবার গণজাগরণ কর্মী খুন হলে জামাত শিবির এবং হেফাজত ইসলাম জয় উল্লাস করছে।বিএনপি কর্মী খুন হলে আওয়ামেলীগ খুশী হচ্ছে ,আবার আওয়ামেলীগ কর্মী খুন হলে বিএনপি খুশী হচ্ছে।পেট্রোল বোমায় সাধারণ মানুষ খুন হলে আওয়ামী বিএনপি জোট উভয়ই খুশী হচ্ছে।প্রতিবাদ ,মানবন্ধন যা দেখছি তা শুধু অন্য মতাদর্শের মানুষের খুন কামনা করে নিজস্ব মতাদর্শের একক আধিপত্যে প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।পুরো জাতিই আজ আমরা প্রতিবাদ প্রতিরোধের পন্থা হিসেবে খুন প্রক্রিয়াকে সাদরে গ্রহন করেছি এবং হত্যাযজ্ঞ আজ বাঙ্গালী সংস্কৃতির এক বিশেষ অংশ হিসেবে রুপ লাভ করেছে।
আমরা যদি মনুষ্যগুন অধিকারী সভ্যমানুষ হয়ে থাকি তাহলে আমাদের দায়িত্ব স্বাধিনতার ৪৪ বছরে পা রাখা স্বাধিন বাংলাদেশের প্রতিটি অপমৃত্যুর ব্যাপারে শোচ্চার হওয়া।সেই অপঘাতে মৃত্যু যদি দেশের একজন সর্বোচ্চ সন্ত্রাসীরও হয় তাও অসমর্থনযোগ্য।কারণ, তার বিচার করবে দেশের আইন আদালত প্রমান ও তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।আদালত প্রয়োজনে মৃত্যুদন্ড দেবে , নাহয় সন্ত্রাসীর সামগ্রিক অপরাধ বিবেচনা করে তাকে জেল বা হাজত বাসের মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে সমাজে ফিরিয়ে দেবে।যদি তানাহয় , তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশের আইন আদালত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা তা বোধগম্য নই।
আবার দেশের জন্য হুমকি স্বরুপ এমন কোনো সংগঠনের কার্যক্রম চিহ্নিত হলে তা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে কঠোর হস্তে দমনের মাধ্যমে সমাজকে স্থিতিশীল রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।কারণ, রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের দেশের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রন করার জন্য রাষ্ট্রের সকল প্রসাশনিক বিভাগকে পরিপূর্ণ ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।তারপরেও যদি সমাজে হত্যা রাহাজানি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে রুপান্তর হয় ,তাহলে প্রথমত বুঝতে হবে রাষ্ট্রের উপর চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্য,অসামর্থ ,অদূরদর্শী এবং বিচক্ষণহীন।
দ্বিতীয়ত, নাহয় শাষকগোষ্ঠী অসৎ ,কুচক্রী এবং স্বার্থান্বেষী, ফলে স্বয়ং গণবিরোধী সরকারের নির্দেশেই যাবতীয় হত্যাকান্ড হচ্ছে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশলগত কারণেই সমাজকে বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে।
উদাহরণস্বরুপ, সাম্প্রতিক সময়ে নিরীশ্বরবাদী বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় , ব্লগার ওয়াসিকুর রহমান হত্যাকান্ড এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন গুম হওয়ার ঘটনাকে যদি বর্তমান সরকারকে উল্লেখিত দুইটি উদাহরনের প্রথমটির সাথে তুলনা করি, তাহলে ধরে নিতে হবে এই সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকার সত্ত্বেও তাদের অযোগ্যতা,অসামর্থতা ,অদূরদর্শীতা এবং বিচক্ষনহীনতা সুযোগে দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং অতিসহজে প্রতিনিয়ত এমন নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকার যদি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হয় তাহলে তাদের উচিৎ জাতীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য মানুষ এবং দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে কাজ করা ।
আর সরকার যদি উদাহরনের দ্বিতীয় কারন হয় অর্থাৎ অসৎ ,কুচক্রী এবং স্বার্থান্বেষী তাহলে মনে
করতে হবে উল্লেখিত প্রত্যেটি ঘটনা সরকার স্বয়ং সুপরিকল্পিত ভাবে ঘটাচ্ছে।সেই দৃষ্টিকোন থেকে অভিজিৎ ,ওয়াসিকুর ,সালাহউদ্দিনের
ঘটনায় সরকার লাভবান হয়েছে ,কারন :
প্রথমত সরকার দেশের বিরুধী
শক্তিকে দমিয়ে রাখতে বহির্বিশ্বের কাছে প্রমান করতে চায় বাংলাদেশে জংঙ্গী তৎপরতা উত্থান ঘটেছে এবং অভিজিৎ ,ওয়াসিকুর হত্যাকান্ড তা প্রমান করতে অনেকখানি সুযোগ সৃষ্টি করেছে।সরকার বুঝাতে চায় দেশ এখন মুক্তচিন্তার
মানুষেরা নিরাপদ নয় এবং মৌলবাদী শক্তি যদি ক্ষমতা দখল করে তাহলে দেশ আরো অনিরাপদ অবস্থার
দিকে ধাবিত হবে, তাই নির্বাচন ছাড়াই দেশ আমাদের কাছেই নিরাপদ ।
দ্বিতীয়ত এই হত্যাকান্ডের
ব্যাপারে সরকারের নীরবতা ও নির্লিপ্ততা প্রমান করে অভিজিৎ ,ওয়াসিকুর যেহেতু নিরীশ্বরবাদী মানুষ ছিলেন তাদের হত্যাকান্ড নিয়ে বেশী মাতামাতি করলে দেশের কট্টর ঈশ্বরবাদী মানুষদের মধ্যে সরাকারের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হতে পারে তাই এই হত্যাকান্ড অতি ঈশ্বরবাদী দল , সংগঠন এবং মানুষের সমর্থন পেতে সরকারকে সহায়তা করছে।
তৃতীয়ত সরকারের নিজস্ব এজেন্ট কর্তৃক হত্যাকান্ডগুলো সংগঠিত হচ্ছে বলেই পুলিশের সামনেই হত্যাকান্ড সংগঠিত হলেও পুলিশ জেনে শুনেই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে এবং প্রতিটি হত্যার সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষ বিচার হলে সরকারের বিপক্ষে ভয়ংকর সত্য বেরিয়ে আসার ভয়েই সরকার বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ধামাচাপা দিচ্ছে।
আর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের গুমের ঘটনা
ভোটবিহীন সরকারের বিরোধী নিধনের কাপুরুষিত নীলনকশারই অংশ বিশেষ মাত্র।
বিচার বিশ্লেষন স্বরুপ, যদি উল্লেখিত কারণগুলো সত্য হয়, তাহলে আমাদের সবার উচিৎ এই ধরনের মূখোশধারী সরকারের বিরুদ্ধে গণঅবস্থানের মাধ্যমে পতন ঘটিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য চিন্তা করা এবং প্রত্যেকের অবস্থান থেকে একটি সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করা।
আজ আমরা প্রত্যেকেই যে মতাদর্শের মানুষই হইনা কেন, সেই মতাদর্শ যদি অন্তরে হিংসা বিদ্বেষের উদয় ঘটায় ,মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করে ,অন্যের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীল হতে না শিক্ষা দেয় তাহলে বুঝতে হবে উহা মতাদর্শের নামে ভন্ডামি মাত্র। আজ আমরা যারা এমন মতাদর্শের অনুসারী হয়ে অন্য মতাদর্শের মানুষের হত্যাকান্ডে নিজের মধ্যে বিজয় আনন্দ লাভ করি ,মনে করবেন এটা আপনার বিজয় নয় বরং এই নৃশংসতা আরও একটি বুলেটকে প্রস্তুত করছে আপনারই রক্তে হলি উৎসব করার জন্য।