বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

পেই দো লা লোয়ার'য়ে চারদিন। পর্ব - ২

১০ আগস্ট সবার ঘুম থেকে উঠতে প্রায় দশটা বেজে গেলো। পরিশ্রান্ত শরীর তার প্রাপ্যটুকু ঠিক মতই বুঝে নিয়েছে।সকালের আলস্য ভাবের সাথে নাস্তা করতে করতেই বেলা মধ্যগগনে গিয়ে পৌঁছুলো। ভাবলাম তাহলে মধ্যাহ্ন ভোজের পর্বটা বাসায় সেরে গেলেই উত্তম।দুপুর দেরটার দিকে আমরা ধীরে সুস্থে বাসা থেকে বের হলাম।সুন্দর আলো ঝলমলে দিন,সূর্য  মাথার উপর তির্যকভাবে অবস্থান নিয়েছে। নন্ত শহরে আমাদের প্রধান আকর্ষণ Grand éléphant অর্থাৎ বড় হাতি পরিদর্শন।এটি des machine de lil এর একটি পার্ট। ইন্টারনেটে নন্ত শহর সম্পর্কে জানতে গিয়ে এই হাতির ছবি দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। তাই তেরত ট্রাম স্টেশনে গিয়ে এক তরুণকে মুঠোফোনে হাতির ছবিটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই স্থানে কিভাবে যাবো। ছেলেটি বলল, আপনাদের (Chantiers navals) ছন্তিয়ের নাভেল ট্রাম স্টেশনে নেমে সেতু দিয়ে নদী পার হতে হবে। সেতু পার হলেই Parc des Chantiers। এখানেই বড় হাতিটি রয়েছে। এখানকার ট্রাম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নাম tan তান। ফ্রান্সের প্রতিটি শহরেই স্থানীয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার কিছু ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম ও সুযোগ সুবিধা রয়েছে।আমরা যখন তেরত ট্রাম স্টেশনের অটোমেশিনে টিকেট কাটতে গেলাম তখন স্থানীয় এক অপেক্ষমান যাত্রী আমাদেরকে এখানকার ট্রাম ও বাস টিকেটের কিছু নিয়ম কানুন ও সুবিধার কথা বুঝিয়ে বললেন।তিনি বললেন, প্রতিবার শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য আলাদা আলাদা টিকেট কাটলে বেশী খরচ পড়বে কিন্তু একবারে দশ ইউরো দিয়ে যদি একটা টিকেট কাটা হয় তবে এই এক টিকেটে চার জন যাত্রী চব্বিশ ঘণ্টা ইচ্ছে মত শহরের মধ্যে দিয়ে বাস ও ট্রামে ঘুরতে পারবে।ভেবে দেখলাম,আমরা তিনজন যদি শুধু তিনটি আলাদা টিকেট কেটে শহরে যাই তাতেই প্রায় ছয় ইউরো চলে যাবে,আবার আসার সময় ও শহরে ঘোরাঘুরির সময় টিকেট কাটতে হবে, সবমিলিয়ে শুধু আজকেই টিকেট বাবদ অনেক ইউরো চলে যাবে। সব চিন্তা করে অপশনটা আমাদের জন্য খুবই সাশ্রয়ী ভেবে গ্রহণ করলাম।আমরা তেরত থেকে ট্রামে করে চলে এলাম ছন্তিয়ের নাভেল।এখানে নেমে আমাদের যাওয়ার পরিকল্পনা দে মাসিন দে লিল অর্থাৎ বড় হাতি পরিদর্শন করতে, কিন্তু  স্টেশন থেকে একটু দূরে কিছু মানুষের ভিড় দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম।স্থানটিতে পর্যটকেরা ভিড় করে আছে। এটি নন্ত শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা প্রমত্ত লোয়ার নদীর একটি খেয়া ঘাট। নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য খেয়ার প্রতীক্ষায় স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকেরা সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।খেয়া ঘাটে কিছুক্ষণ পর মাঝারী আকারের একটি জাহাজ নোঙ্গর করলো।ইচ্ছে হল,এই খেয়া জাহাজে করে নদীর ওপারে যাওয়ার।ঘাটের টিকেট কাউন্টার অফিসের পাশে একটি পোস্টারে খেয়া পারাপারের মূল্য ও টীকা আকারে কিছু নিয়ম লেখা রয়েছে। নিয়মগুলো পড়ে মনে হল আমরা চব্বিশ ঘণ্টা মেয়াদের বাস ও ট্রামের জন্য যে টিকেট কেটেছি সেই টিকেট দিয়েই খেয়া পার হতে পারবো। তবুও টিকেট কাউণ্টারে বসা দায়িত্বরত এক তরুণীকে আমাদের টিকেটটি প্রদর্শন করে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি এই টিকেট দিয়ে খেয়া পার হতে পারবো, নাকি আলাদা টিকেট কাটতে হবে? তরুণী আমাদের টিকেটটি একটি মেশিনে পরীক্ষা করে বলল, খেয়া পারের জন্য আপনাদের আলাদা টিকেট কাটতে হবে না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই টিকেট দিয়ে আপনারা ইচ্ছে মত খেয়া জাহাজ, বাস ও ট্রাম ব্যবহার করতে পারবেন।খুব ভালো লাগলো শুনে আমাদের আলাদা টিকেট কেটে খেয়া পার হতে হবে না। খেয়া ঘাটের এই টিকেট অফিসটি নন্ত শহরের স্থানীয় পর্যটন সেবা কেন্দ্রও।বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকদের এই শহরের পর্যটন স্থানগুলোর নানাবিধ তথ্যও দেয়া হচ্ছে এখান থেকে।এছাড়া, ফ্রেঞ্চ,ইংরেজি, স্প্যানিশ, চাইনিজ ভাষা সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পর্যটন তথ্য সম্বলিত ছাপানো বই রয়েছে এখানে।পর্যটকেরা প্রয়োজনীয় ভাষার তথ্যবই তথ্য সেবা প্রদানকারী কর্মীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিচ্ছে। বইগুলো বিনা মূল্যে সরবারহ করছে।আমরা, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষার দুটি বই সংগ্রহ করে খেয়া জাহাজের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়ালাম।প্রবাস জীবন প্রায় দশ বছরের।নিজের জন্মস্থান রাজবাড়ী ছেড়ে ঢাকায় বসবাস ছিল ছয় বছর।জীবনের ষোল বছর চলছে নগর বাস।আমার বেড়ে ওঠা মফস্বল শহরে হলেও কাদামাটির স্পর্শ রয়েছে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে।একজন গ্রাম্য বালকের মতই গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নিয়েছি পরিপূর্ণভাবে। নন্ত শহরের লোয়ার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে, অনেক বছর পর আমি আমার বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মার সুতো নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে খেয়া নৌকার অপেক্ষা করছি।লোয়ার নদীটি খুব বেশী প্রশস্ত নয়, এবং আশ্চর্যের বিষয় এই নদীর জল ঘোলা, আমাদের পদ্মা নদীর জলের মত। অনেকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম।চোখে ভেসে উঠছিল সেই ছেলেবেলার সুতো নদীর অনেক ছবি।আমাদের বাড়ী থেকে ১০ মিনিটের পথ হাঁটলেই পদ্মা নদীর তীর।এখন মূল পদ্মা নদী প্রবাহিত শহরের কোল ঘেঁষে, কিন্তু একসময় মূল পদ্মা নদীর তীরে যেতে হলে শাখা নদী পার হয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো।শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো পদ্মার সুতো নদী বা শাখা নদী। প্রমত্ত পদ্মার বিশালতার কাছে এই শাখা নদীটি  সুতোর মতই ছিল।বড় পদ্মার নদীর শরীর থেকে ছোট্ট একটি অঙ্গ বেরিয়ে রাজবাড়ীর কালীতলা হয়ে  মিশে গিয়েছিল গোয়ালন্দের মূল পদ্মা নদীর সঙ্গে। মূল পদ্মা আর এই সুতো নদীর দূরত্বের মাঝে ছিল বিশাল চর অঞ্চল।এই চরে ছিল হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা ও বসতী।চড় সিলিমপুর, আম্বাড়ীয়া চর আরও কিছু নাম ছিল এই চরের মধ্যকার বিভিন্ন গ্রামের। আমার জীবনে নদীর সাথে পরিচয় ও নদীর স্মৃতি বলতে এই পদ্মার সুতোনদীকেই ঘিরে।বিশাল প্রমত্ত মূল পদ্মার প্রথম দর্শনের স্মৃতি মনে নেই, তবে কৈশোরে পা দিয়ে কৌতূহল বসত বন্ধুদের সাথে কোন শুকনো মৌসুমে সুতো নদী পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে ওপারের ফসলী মাঠ, পাড়া গাঁ মাড়িয়ে একদিন ধু ধু পদ্মার পাড়ে  দাঁড়িয়ে পদ্মার বিশালতার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো আমার। 

ছেলেবেলায় পদ্মার এই শাখা নদীটিই ছিল আমার গণ্ডী জীবনের কল্পনায় সবচেয়ে বড় নদী।ভরা মৌসুমে এই নদী ভয়ংকর রূপ ধারণ করতো।বিশাল ঢেউ আঁচড়ে পড়ত নদীর দুই পাড়ে। ঢেউয়ের প্রবল আঘাতে কখনো পাড় ভেঙে পড়ত। নদীর এপারে রাজবাড়ী শহর, ওপারে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। এপারে নদীর পাড় দিয়ে কোথায় ফসলী মাঠ,কোথাও ঘন দেবদারু ও গাব গাছের জংলা প্রকৃতি।।দুই পাড়ের মানুষের একমাত্র সংযোগ মাধ্যম ছিল বৈঠাচালিত খেয়া নৌকা। চর অঞ্চলের মানুষের প্রধান উপজীব্য ছিল কৃষিকাজ, পশুপালন এবং মৎস্যশিকার। মেছোঘাটা, গোদার বাজার ঘাট ছিল একসময়ের ব্যস্ততম নৌবন্দর। এই ঘাটগুলো থেকে নৌপথে পরিবাহিত হতো দূরবর্তী পণ্য ও যাত্রী।আমার দুরন্ত ছেলেবেলা থেকে যৌবনের সোনালি সময়ের সাথে পদ্মার এই সুতোনদীটির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় । 


কৈশোরে বন্ধুরা দল বেধে নদীর পাড় ধরে অনেক দূরে চলে যেতাম,পড়ে একসাথে নদীতে ঝাপ দিয়ে সবাই সাঁতার কাটতে কাটতে চলে আসতাম ঘাটে। আবার নিজের সাহসিকতা পরীক্ষার জন্য অনেকবার  সাঁতার কেটে নদীর ওপার  গিয়ে আবার একাই ফিরে এসেছি এপারে। ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুপসাঁতার কাটতে কাটতে চোখ লাল হয়ে যেতো। কখনো দল বেধে নদীর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সাঁতার কেটে চলে যেতাম নদী ওপারে। নদীর ধারে কৃষকের ক্ষেতে লেগে পড়তাম ক্ষীরা অথবা বাংগি তুলতে। যখন দেখতাম ক্ষেতের কৃষক তেড়ে আসছে আমাদের দিকে অমনি আবার নদীতে ঝাপ দিতাম, সাঁতার কেটে চলে আসতাম এপারে। 

বড়শী দিয়ে মাছ ধরা ও ঘুরি ওড়ানোর নেশায় কখনো স্কুল ফাঁকি দিয়ে দিন চলে গেছে নদীর পাড়েই। নদীর পাড়  দিয়ে পরিশ্রমী গুণটানা মাঝীর গুণ টেনে হেঁটে চলা ,নদীর বুকে পালতোলা নৌকা থেকে ভেসে আসা গানের সুর স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল।এই নদীতেই এক সময় জেলেদের রূপোলী ইলিশ ধরার ধুম লেগে যেতো। পাঙ্গাশ, বোয়াল সহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় মাছের অবাধ বিচরণ ছিল এই নদীর ঘোলা জলে। সুতো নদীর প্রশস্ততা বেশী না থাকলেও ছিল সুগভীর। মাঝে মাঝে ভারী জাহাজ পার হতো এই ছোট্ট নদীর বুক দিয়ে। কখনো যাত্রা পথে ঘাটে নোঙ্গর করতো। খবর শুনে কৌতূহল ভরে নদীতে যেতাম কাছ থেকে জাহাজ দেখতে। প্রতি বছর এই নদীতে নৌকা বাইচ খেলার আয়োজন হতো,প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য দূর দূরান্ত থেকে দীর্ঘকার বাইচের নৌকায় আসতো।নৌকাগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল,লালন শাহ, শাহ জালাল ইত্যাদি। সাধারণত বিভিন্ন পীর আওলীয়া, মুনি ঋষিদের নাম অনুসরণ করে এইসব প্রতিযোগিতার নৌকাগুলোর নাম রাখা হতো।প্রতিযোগিতা উপলক্ষে নৌকাগুলোকে বিশেষ সাজে সাজানো হতো। নৌকার মাল্লারাও পরত বিশেষ রঙ ও ডিজাইনের পোশাক। নৌকার সামনে ধূপ জ্বালিয়ে মন্ত্র জপতে গেরুয়া পোশাকে বসতেন সাধক, পেছনে বিশাল আকৃতির বৈঠা ধরে দাঁড়াতেন মাঝি, মাঝে মাল্লার দল ছোট ছোট বৈঠায় পানিতে ছন্দ তুলে ছলাত ছলাত শব্দে করে নদীর বক্ষ চিরে এগিয়ে যেতো শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার জন্য।মাল্লাদের সমবেত সুরে গাওয়া বাইচের জারি গানে মুগ্ধ হতো নদীর দুই ধারে অবস্থান নেয়া হাজার হাজার দর্শনার্থী।এখনো সেই সময়ের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলে শরীরে শিহরণ জাগে।


প্রায় প্রতি বছর নদীর উপচে পরা পানিতে বন্যা হতো,নদীর ওপারের চরাঞ্চলে বন্যার পানির সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠত আঊশ, আমন ধান।পানি নেমে গেলে মাঠে নরম পলি মাটির প্রলেপ পরত। কোন কর্ষণ ছাড়াই নরম পলি মাটির কাদায় কৃষক ছিটিয়ে দিতো মাসকলাই ডালের বীজ।কোন সার ছাড়ায় নতুন মাটির উর্বর শক্তিতে সবুজ হয়ে উঠত নদীর ধারের কৃষি  ক্ষেত। কোথাও কোথাও মাঠ জুড়ে আউশ, আমন ধানের নাড়ার বিছানা পাতা থাকতো,এর মধ্যে ফুটে থাকতো আকাশী নীলের কলমি ফুল। খেয়া নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে ওপারের আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে যখন বেড়াতে যেতাম তখন প্রকৃতির এমন অকৃত্রিম রূপে বিমোহিত হতাম। 


এপারে শৌখিন মৎস্য শিকারিদের সাড়ি সাড়ি বাঁশের মাচা আর নদীর ওপারের শরতে ফোটা কাশফুল, এখনো আমার স্মৃতিতে ছবির মত।  


এক সময় পানি কমতে কমতে নদীর বুকটা হয়ে যেতো মরুভূমির বালুকা বেলার মত। মনে হতো নদীর দুই ধারে পাহাড়ের মত সুউচ্চ শক্ত এঁটেল মাটির পাড় আর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শুকনো বালুর মহাসড়ক। এর মধ্যে ছোট্ট বড় কুম ( জমে থাকা গভীর পানির স্থল) পড়ত। নদীতে নতুন পানি না আসা পর্যন্ত এই কুমের মধ্যে চলতো এলাকার মানুষ ও গরু ছাগলের গোছল এবং কাপড় চোপড় ধৌতের কাজ। ছোটবেলায় অনেকবার দাদীর সঙ্গে নদীর কুমে গোছল করতে এসে সাঁতার না জানায় গহীন জলে ডুবে জল খেয়েছি, কেউ না কেউ দেখে আমাকে উদ্ধার করেছে।ছেলেবেলায় আমার সাঁতার শেখা হয়েছে কুমের জলে ডুবে ডুবেই। দাদীর সঙ্গে নদীতে গোছল করতে গেলে সাবানের পরিবর্তে নদীর পাড়ের এঁটেল মাটি দিয়ে চুল পরিষ্কার করে দিতো। শহরতলিতে বসবাস করলেও দারুণ এক গ্রামীণ জীবনের স্বাদ ছিল এই সুতো নদীকে কেন্দ্র করে।

ছেলেবেলায় দেখা বন্ধুদের এক নৃশংস শখের কথা স্মরণ হলে এখনও দারুণ ভাবে অনুতপ্ত হই।দেয়ালের মত নদীর দুই পাড়ের ভাজে ভাজে শত শত গভীর গর্ত থাকতো, সেই গর্তের মধ্যে সংসার পাতত মাছরাঙা পাখীর দল। আমাদের লোভ থাকতো পাখীর বাচ্চার প্রতি।কিন্তু সুগভীর গর্তের মধ্য থেকে হাত ঢুকিয়ে পাখীর বাচ্চা বের করে আনা ছিল দুরূহ কাজ।তাই লম্বা লাঠির সঙ্গে বেতের সীসা পেঁচিয়ে লাঠিটি ঢুকিয়ে দেয়া হতো গর্তের মধ্যে।কখনো লাঠির সঙ্গে বেতের সীসার কাটায় পেঁচিয়ে গর্তের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতো রক্তাক্ত পাখির ছানা।কাজটি ভীষণ অন্যায় ছিল, যা ওই সময়ে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই করতে দেখেছি। ঐ সময়ে আমাদের মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয়নি যে ছোট্ট পাখীর ছানার কাটার আঘাতে দুঃসহ কষ্ট  হতো। মা ছাড়া পাখীর ছানাগুলো বাড়ীতে এনে অতি আদর যত্নে পোষার চেষ্টা করলেও কয়েক দিন পর অধিকাংশই মারা যেতো। ছেলেবেলার দুরন্তপনা বা কৌতূহল বশত এগুলো করা হলেও, আজ বুঝি এমন শখ ছিল বড় রকমের অপরাধ। প্রতিটি প্রাণী তার নিজস্ব জীবন যাপনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার চিন্তা ও বুদ্ধির  প্রয়োগ এবং যত্ন করে তার বাচ্চা লালন পালন করে বড় করে তোলে ,তার মানসিক বিকাশ ঘটায়।একটি মানব সন্তানকে যেমন বনের পশুকে দিয়ে লালন পালন করা সম্ভব নয়, তেমনি ছোট্ট পাখীর ছানাকে মা ছাড়া করে যতই আদর যত্ন করে বড় করে তোলার চেষ্টা করা হোক না কেন, কখনোই ঐ মা পাখীটির মত করে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে ছোট্ট ছানাটির পাখীত্বের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। প্রতিটি প্রাণীই স্ব স্ব গোত্রেই নিজেদের মত স্বাধীন ও নিরাপদ।প্রাণী জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা মানুষেরই দায়িত্ব। এই বোধ এখন জাগলেও তখন ছিলাম বোধহীন।পাটকাঠির মাথায় জিগার আঠা জড়িয়ে গাং ফড়িং শিকার করে কত চৈতালি দুপুর কেটেছে এই নদীর পাড়ে তার হিসেব নেই।সেটাও ছিল ঐ সময়ের বোধহীন শখ।ফড়িংগুলো ধরার পর  যখন আবার ছেড়ে দিতাম তখন ওরা ভালোভাবে উড়তে পারতো না। কারণ পাখায় লেগে থাকা জিকার আঠার ভারে ফড়িংয়ের স্বচ্ছ পাতলা ডানা দুর্বল হয়ে যেতো।  


উদিত যৌবনে সুতোনদী আমাকে দিয়েছে অনেক সোনালী মুহূর্ত।প্রতিটি বর্ষাকাল মানে নদীর নব যৌবন।নদীর বুকে ঢেউয়ের খেলা, পাড় ছুঁই ছুঁই পানি। স্কুল,কলেজের ক্লাস শেষ করে প্রতিটি বিকেল রুটিন করে কাটত এই নদীর পাড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই দূর করে দিতো পড়ন্ত বিকেলের নদীর পাড়। নদীর পাড় ধরে কোথাও বসত বাড়ী,আবার কোথাও বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত, সেই ক্ষেতে খোলা বাতাসে চলে কচি সবুজ ধান গাছের ঢেউ খেলানো নৃত্য, সঙ্গে বয়ে চলা নদীর ঘোলা জল তোলে কল কল ধ্বনি।এমনি এক নৈসর্গিক প্রকৃতির মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে কেটেছে অসংখ্য বিকেল। এই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভালোলাগা ভালোবাসার আবেগ অনুভূতিতে আপ্লূত হয়েছি অনেক বার। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের নিচে বসে পানিতে পা ভিজিয়ে নদীর বয়ে চলার দৃশ্য দেখা আমার জীবনের এক অম্লান স্মৃতি।           


এতক্ষণ যে ছোট্ট নদীর এতো কথা মনে আঙিনায় ভেসে উঠলো, সেই নদীটি এখন কালের আবর্তে বিলীন। এখন শুধুই স্মৃতি। নদীর এপার ওপারের মানুষের সহজ যোগাযোগের মাধ্যম একটি সেতুর দাবী ছিল দুই পাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের। বিগত বিএনপি সরকারের শাসন আমলের শেষের দিকে স্থানীয় প্রশাসন নিলো এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত, সেতু স্থাপন না করে বরং শুষ্ক মৌসুমে নদীর মাঝে বাঁধ নির্মাণ করে নদীটিকে বেধে দিলো। হত্যা করা হল একটি জীবন্ত যৌবনা নদীকে। তাদের কাছে এই নদীটি অতিরিক্ত অসহ্য মনে হয়েছিল।লোক মুখে কথিত, তৎকালীন স্থানীয় ক্ষমতাসীনরা হয়তো পরিকল্পনা করেছিল প্রমত্ত এই ছোট্ট নদীটিকে দীর্ঘ একটি দীঘিতে রূপান্তর করে মাছ চাষ করবে।এতে স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থান হবে।দুই পাড় এক হয়ে গেলে ওপারের মানুষকে কেউ আর চরের মানুষ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে না।এই বাঁধের কারণে দুই পাড়ের মানুষ এক হয়ে শহুরে মানুষ হয়ে যাবে। এই জেলায় রইবে শুধুমাত্র একটি নদী, তা হল জেলাশহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৃহৎ মূল পদ্মা নদী। আজও মানুষের মনে সন্দেহ, বস্তুত কি পরিকল্পনায় এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো,এই সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের গবেষণা ছিল কিনা? কারণ পদ্মার এই সুতোনদীটির বুকে বাঁধ নির্মাণের পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে মূল পদ্মার ভাঙন শুরু হয়,আগ্রাসী ভাঙন! সেই ভাঙনে নদী গর্ভে বিলীন হয় শতশত ঘরবাড়ী,স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা,ফসলি মাঠ।সেই ভাঙ্গনের ধারাবাহিকতায় কয়েক বছরের মধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় চর সিলিমপুর, আম্বারিয়ার চরের মত বৃহত্তর গ্রাম। হাজার হাজার মানুষের জীবনে নেমে আসে দুঃসহ অন্ধকারের ভবিষ্যৎ। জমি ও বসত বাড়ী হারিয়ে চর অঞ্চলের এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাস্তুহারা হয়ে পেশাগত সঙ্কটে পড়ে। বাধ্য হয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠী জেলা সদর ও এর আশে পাশের অনেক কৃষি জমি কিনে বসতি স্থাপন করে। অনেকেই স্থান নিয়েছে বেড়িবাঁধ,রাস্তার ধারে, কেউবা অন্যের জমিতে এখনও আশ্রিত। যার ফলে রাজবাড়ী জেলা সদর পরিণত হয় একটি ঘনবসতি অঞ্চলে। শহর হারিয়েছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য, ওপারের বংশপরম্পরায় কৃষক, জেলে, নৌকা শ্রমিক হারিয়েছে জীবনের ছন্দ। তাদের কেউ এখন জেলা শহরে রিক্সা চালিয়ে,কেউ রাজমিস্ত্রি’র কাজ করে জীবন চালায়। অনেকেই বাধ্য হয়ে জীবীকার তাগিদে ঢাকার নগর জীবন বেঁছে নিয়েছে। দুচোখে স্বপ্ন, নদীর বুকে আবার কবে জেগে উঠবে চর, আবার ঘর তুলবে পুরনো স্মৃতিবিজড়িত বাস্তুভিটায়। 

 

এখন মূল পদ্মা নদী রাজবাড়ী জেলা শহরের কোল ঘেঁষে প্রবাহিত। প্রতি বছর নদীর ভরা মৌসুমে পদ্মার তর্জন গর্জনে তটস্থ হয়ে ওঠে শহরবাসীর জীবন। ভয়,এবার রাজবাড়ী শহর কি টিকতে পারবে পদ্মার আগ্রাসী আক্রমণকে প্রতিহত করে। শহর বাঁচাতে প্রতি বছর পদ্মার তীর চলে সরকারের শত শত কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ। এখন পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চোখে পড়ে আদিগন্ত জলরাশি।কল্পনায় ভেসে ওঠে এই পানির বুকে একসময়ের জেগে থাকা গ্রাম,মানুষের কোলাহল আর আমার ছেলেবেলার সুতোনদী। 


ওই সময়ের  ক্ষমতাসীন কোন এক গোয়ার,স্বার্থপর ও লোভী  মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে পরিবর্তন হয়ে গেছে একটি জেলার মানচিত্র।পরিবর্তন হয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা। আমাদের দুর্ভাগা দেশের ঘাড়ে চেপে বসা লোভ লালসার নেতৃত্বের কারণে এমন অনেক ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্ত সমগ্র জাতিকেই সর্বনাশা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।  


ছেলেবেলার দুরন্তপনায় অনেক বার সাঁতার কেটে সুতো নদী পাড়ি দিয়েছি, সেই অভিজ্ঞতায় লোয়ার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল চাইলে এই ভিনদেশি নদীটিও সাঁতার কেটে পাড়ি দেয়ার সক্ষমতা এখনো আমার রয়েছে।অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পর ওপার থেকে খেয়াযাত্রী বহন করে খেয়াতরী জাহাজ এসে ঘাটে ভিড়ল।ওপারের খেয়াযাত্রীরা  জাহাজ খালি করা মাত্র আমাদের অপেক্ষমাণ যাত্রীরা লাইন ধরে জাহাজে উঠতে লাগলো,নির্দিষ্ট যাত্রী সংখ্যা পূর্ণ হওয়ার পর জাহাজের নাবিক অনন্যা যাত্রীদের পরবর্তী খেয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রেখে জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিলো। ভাগ্য ভালো লাইনের সামনে থাকায় আমাদেরকে পরবর্তী খেয়ার অপেক্ষমাণ লাইনে আর দাঁড়াতে হল না। আমাদের তরি মাঝ নদী দিয়ে ওপারের দিকে এগুতে লাগলো।নদীর মাঝখান থেকে তরিতে বসে শহরের অবয়ব ভিন্নরকম দেখায়।নদীর দুই পাড় দিয়ে গড়ে উঠছে শহরের মানুষের বসবাসের ভবন বাড়ি, অফিস,কমার্শিয়াল সেন্টার,বিনোদন কেন্দ্র। সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলো এই ছোট্ট শহরকে এক শৈল্পিক রূপ দিয়েছে।মাঝ নদী থেকে অবলোকন করলে সেই রূপ ধরা দেয়। মনে হল, এই নদী নন্ত শহরের দুই পাড়ের মানুষকে একটুও ব্যাবচ্ছেদ করেনি বরং দিয়েছে সৌন্দর্য,অটুট মেলোবন্ধন। খেয়া তরি থেকে দুই দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইটি সেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর বুকে।


















দশ মিনিটের খেয়া যাত্রা শেষ করে আমরা চলে এলাম নদীর এপার।একটু গ্রাম্য আবহ খুঁজে পাওয়া গেলো।ঘাটের সঙ্গে রেস্তোরাঁর তেরাজে বসে নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুজব করে খাওয়া দাওয়া করছে লোকজন। নদীর পাড়ের  সাড়ি সাড়ি পুরনো সেঞ্চুরি গাছের পাশ দিয়ে চলে গেছে পিচ ঢালা সরু রাস্তা।শান বাধানো নদীর কিনার দিয়ে পুরনো ডিজাইনের লোহার রেলিং।আমরা গন্তব্যহীন এই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এগুতে লাগলাম।কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম একটা জংলা প্রকৃতি। গাছপালায় ঘেরা, নদীর কিনার দিয়ে জলজ উদ্ভিদ ইচ্ছে মত বেড়ে উঠেছে।মনে হচ্ছে, আমাদের গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন নদীর ধারে চলে এসেছি।এই প্রকৃতির মধ্যে লাল রঙয়ের সুউচ্চ টিনের তৈরি একটি স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাছে কোন পুরনো আমলের নিদর্শন। কোন এক সময়ের কোন উৎপাদনশীল কারখানার একটি ইউনিট মনে হল।স্থাপনাটির এক পাশে সুবিশাল একটি ঘড়ির পেন্ডুলাম প্রতিনিয়ত এদিক ওদিক করে দুলে যাচ্ছে। ভালো লাগছিলো পেন্ডুলামের এই দুলে চলা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম দুলেচলা পেন্ডুলামের দিকে। মনে হল, জীবনটাও এই পেন্ডুলামের মতই।ঘড়ির পেন্ডুলাম যেমন দুলতে দুলতে একদিন থেমে যায়, মানুষের জীবনটাও এই দোলাচলের মধ্যদিয়ে একদিন চিরস্থায়ী ভাবে থেমে যায়।নশ্বর পৃথিবীর মাঝে আমাদের নশ্বর জীবন।কিন্তু এই ধ্রুব সত্য আমরা জীবদ্দশায় খুব একটা গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পারিনা। এমন সুন্দরের মাঝে মিশেল বেশ বেয়াড়া হয়ে উঠলো। ইচ্ছে মত ছোপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে আর আমাদের চিন্তা বাড়াচ্ছে। আশংকা নতুন জায়গা যদি একটা অঘটন ঘটে।বেশ বিরক্ত হয়ে ওকে রেখেই আমরা ওখান থেকে চলে এলাম,ভাবলাম ভয়ে আমাদের পিছু পিছু চলে আসবে। অনেক দূর আসার পর পেছন ফিরে তাকিয়ে মিশেলের দেখা মিলল না। আমি আবার জংলার দিকে ছুটে গেলাম,একটু খোঁজাখুঁজির পর দেখি সে টিনের স্থাপনার একপাশে নদীর দিক মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। জোর করে ওকে নিয়ে এলাম ওখান থেকে।

 
















আমরা নদীর পাড় থেকে একটি সিটি বাসে উঠে বসলাম। বাসের ড্রাইভারকে বললাম আমরা « Grand éléphant »  বড় হাতির কাছে যেতে চাই, কিভাবে যাবো সে ব্যাপারে যদি দয়া করে  আমাদেরকে নির্দেশনা দেন।সেই অনুযায়ী  বাসের ড্রাইভার একটি ট্রাম ষ্টেশনের কাছে এসে আমাদের গন্তব্যের  ট্রাম ষ্টেশনের নাম বলে নামিয়ে দিলেন।কিন্তু তার নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে একটু ধাঁধায় পড়ে গেলাম। আবারো ট্রাম ষ্টেশনের এক অপেক্ষমাণ যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে ট্রামে উঠে পড়লাম। শহরটা আমাদের দেশের মফস্বল শহরের মত।মানুষের তেমন ছুটোছুটি নেই।ঘরবাড়ীগুলো মধ্যে আভিজাত্যের ছোঁয়া রয়েছে।দুই একটি পুরনো দিনের খৃস্ট ধর্মীয় উপাসনালয় চোখে পড়লো।মাঝে মাঝে পার্কে শিশুকিশোররা খেলাধুলা করছে।সিটি কর্পোরেশন কোথায়ও কোথাও রাস্তার পাশে নান্দনিক ফলক তৈরি করে রেখেছে। চোখে লাগা একটি সুন্দর ফলক দেখে মনে হল এই এলাকাগুলো হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখলে মন্দ হয়না। আমরা পরের ষ্টেশনেই নেমে পড়লাম। হাঁটাহাঁটি করতে করতে চলে এলাম শহরের ব্যস্ততম এলাকায়।এলাকাটির  নাম কমার্স। এই শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা।এই শহরের কেন্দ্রবিন্দু বলা হয় এই এলাকাকে।এখানে ফ্রান্সের বড় বড় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল  ব্রান্ডের শোরুম রয়েছে। দোকান ও বিল্ডিঙগুলো প্যারিসের সাঁতলে এলাকার মত।মনে হল আমরা প্যারিসেই আছি। ব্যস্ত এলাকা, স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত এলাকা।পর্যটন মৌসুমে প্যারিসের পর্যটন স্থানগুলো পথ শিল্পীদের নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জেগে ওঠে। পর্যটন এলাকাগুলোতে হাঁটাহাঁটি করলে কানে ভেসে আসে সংগীত বা কোন বাদ্য যন্ত্রের সুরের মূর্ছনা, চোখ আটকে যায় কোন কোন অভিনয় শিল্পীর মুখাভিনয় দেখে। অনেক শিল্পী বিখ্যাত কোন মানুষের ভাস্কর্যের মত পরিচ্ছদ পরে বাস্তব মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। পর্যটকরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে, খুশি হয়ে তাদেরকে পয়সা দেয়।অনেক নৃত্যশিল্পী রাস্তার পাশে মজমা জমিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে পর্যটকদের আনন্দ দেয়।আবার কেউ কেউ ক্রীড়া নৈপুণ্যও দেখিয়ে থাকে। পর্যটন মৌসুমে এগুলো প্যারিসের পথেঘাটের অতি সাধারণ চিত্র। নন্ত ছোট্ট শহর কিন্তু প্যারিসের মতই পথশিল্পীরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পর্যটন স্থানগুলো মাতিয়ে রেখেছে।আমরা অনেকক্ষণ একজন বাদ্যযন্ত্র শিল্পীর ভিন্নধর্মী এক বাঁশীর সুরে বিমোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের মত আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিল্পীর বাঁশীর সুর শুনছে। বাঁশীটির আকৃতি মোটা বাঁশের মত এবং দীর্ঘাকার। ভিন্নধর্মী মোটা সুরের বাঁশীটি বাজাতে দারুণ শারীরিক কসরত করতে হয়, তা বোঝা গেলো শিল্পীকে দেখে। খর্বদেহী শিল্পীযুবক খালি গায়ে যখন মুখে বাঁশী আর হাতে ঢোল প্রজাতির এক বাদ্য যন্ত্রে সুর তুলে যাচ্ছে তখন তার শরীর থেকে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শক শ্রোতাদের মধ্য থেকে অনেকেই তার বাঁশীর সিডি ক্যাসেট কিনছে আবার অনেকেই সামনে রাখা শিল্পীর টুপীর মধ্যে মুগ্ধ হয়ে টাকা রাখছে। মনে হল, বাঁশীটি হয়তো আফ্রিকার কোন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাঁশী হবে।   
ফরাসি দেশকে শিল্প সংস্কৃতির দেশ বলা হয়। কারণ, এই দেশের মানুষ শিল্পকে ভালোবাসে এবং শিল্পীকে সম্মান করে।ফরাসি সরকারও শিল্প ও শিল্পীকে পৃষ্ঠপোষকতা করে।এর প্রমাণ মেলে ফরাসিদের রুচি পছন্দ ও দৈনন্দিন জীবনধারায়।এখানকার মানুষ ছুটির দিনে টিকেট কেটে থিয়েটার ও বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনী দেখতে যায়, বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে নিয়মিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়, সেখানেও উপচে ভীর দেখা যায়।নতুন কোন গানের এ্যালবাম বের হলে সেই এ্যালবাম ইন্টারনেট থেকে অথবা সিডি কিনে শোনে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।


খানে যাদেরকে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতে দেখি তারা মূলত একেবারেই শৌখিন শিল্পী নয়। তাদের অধিকাংশই নানা শিল্পের উপর একাডেিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।তাই ফ্রান্সের রাস্তার ধারের কোন শিল্পীর পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ ও অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।এখানকার একজন শিল্পী মনে করেন, শিল্প মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য, তাই মানুষের উপস্থিতি যেখানে শিল্পকে সেখানে নিয়ে যাওয়া শিল্পীর দায়িত্ব। মানুষের মাঝেই একজন শিল্পী বিকাশ লাভ করে থাকে, তাই নিজের শিল্পকে প্রদর্শনের জন্য শুধু বড় আলো ঝলমল মঞ্চের প্রয়োজন এমনটা হয়তবা ফরাসি শিল্পীরা মনে করেন না। তাই শিল্পের অহংকারমুক্ত হাজার হাজার গুণীশিল্পী গড়ে ওঠে এই ফরাসি দেশে।শিল্পের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে শিল্প প্রদর্শন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন না। এই দেশে গড়ে ওঠা একজন শিল্পী যখন তারকা হয়ে ওঠে তখন তার ব্যক্তিত্বে নক্ষত্রের জ্যোতি ছড়ায়।শিল্পীর অহংবোধের মধ্য দিয়ে নয় বরং মানবিক আচরণের মধ্য দিয়ে। 



কমার্স এলাকার একটি সুভেনিরের দোকান থেকে মিশেল নিজের ও তার এক বন্ধুর জন্য কিছু কেনা কাটা করলো।এর পর ধীরে ধীরে গন্তব্যহীন ভাবে এলাকাটা ঘুরে দেখতে লাগলাম।মনে হচ্ছেছিলনা অন্য শহরে আছি,প্যারিসের ছা মিশেল এলাকায় রয়েছি।এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে দেখি আমরা প্লাস রয়্যাল চলে এসেছি, সেই শত শত ভাস্কর্যের প্রদর্শনী এলাকায়।আসলে নন্ত শহরটি খুব বড় শহর নয়, আমাদের দেশের বড় জেলা শহরের মত।মূল শহরটি হেঁটে হেঁটেই ঘুরে বেড়ানো যায়। নন্ত শহরটি আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জনসংখ্যার ভিত্তিতে নন্ত ফ্রান্সের ষষ্ট জনবহুল শহর।এই শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত লোয়ার নদীর মোহনায় অবস্থিত ফ্রান্সের অন্যতম সমুদ্র বন্দর ছা নাজায়ার। 

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভাবে নন্ত প্রাক্তন ডিউক শাসিত অঞ্চল এবং এটি এক সময় ব্রিটানি প্রদেশের অংশ ছিল। 

নন্ত পে দ্য লা লোয়ার রেজিওঁর প্রধান প্রশাসনিক শহর। 


আমরা প্লাস রয়্যালে এবার বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।প্রায় প্রতিটি মূর্তি খুব কাছ থেকে দেখলাম,ভালোলাগা ভাস্কর্য ধরে ছবি তুললাম। ছোট আকারের প্রাণীর ভাস্করের পিঠে চড়ে মিশেল নিজের মত আনন্দ করতে লাগলো।কখনো এই শত শত ভাস্কর্যের রাজ্যে নিজের মত দৌড়াদৌড়ি করে আমাদের থেকে কয়েকবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। 













প্লাস রয়্যালের পাশে আকাশমুখী সুউচ্চ মিনার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাঝারি আকৃতির খ্রিস্ট ধর্মীয় উপাসনালয়।এখানে ছোট আকৃতির গির্জাকে ইগ্লিস, বড় আকৃতির গির্জাকে বলে ক্যাথেড্রাল।এটি একটি ক্যাথেড্রাল।কোন বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল না হলেও এর স্থাপত্য শৈলী বেশ আকর্ষণীয়।মধ্যযুগীয় ও আধুনিক নক্সায় তৈরি একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন।প্লাস রয়্যাল থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু সুন্দর সময় কাটল এখানে।




দিনের এতোটুকু ঘোরাঘুরিতে  ইতোমধ্যে এই অচেনা শহরটা আমাদের অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে।পথঘাট ও অলিগলি ঘুরপ্যাঁচ অনেকটাই বুঝে ফেলেছি।আমরা বিকেল ছয়টার দিকে প্লাস রয়্যাল এলাকা থেকে বেরিয়ে এবার হাঁটতে হাঁটতে লোয়ার নদীর সেতু উপর দিয়ে চলে এলাম  (des machine de lil) দে মাসিন দো লিল এলাকায় অর্থাৎ আমাদের কাঙ্ক্ষিত বড় হাতির কাছে।নদীর এপারে শহরের মানুষের ব্যস্ততার ছোটাছুটি নেই।মনে হল,শহরের এপার রাখা হয়েছে মানুষের অবকাশ যাপনের জন্য।ফ্রাসের প্রতিটি শহরেই মধ্যযুগীয় বড় বড় খ্রিস্ট ধর্মীয় গির্জার নিদর্শন মেলে।কিন্তু গির্জাগুলোর আয়তন আকারে উপাসনাকারী ধার্মিকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী গির্জার শাসনের সময় এই উপাসনা কেন্দ্রগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো।বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম যখন বিচ্ছিন্ন হয় তখন থেকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের ক্ষেত্রে ফরাসিদের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে,তাছাড়া ধর্মীয় অনেক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসেও পরিবর্তন শুরু হয়।এখানকার ফরাসি জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশের পারিবারিক ধর্মীয় পরিচয় থাকলেও তারা ধর্ম পালন ও বিশ্বাস করে না।কিন্তু ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তারা সৎ ও মানবিক মানুষ।ফ্রান্সের ঐতিহাসিক খ্রিস্ট ধর্মীয় গির্জাগুলোতে যতটা না উপাসনার জন্য গুরুত্ব পায় তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব পায় পর্যটন স্থান হিসেবে। প্যারিসের স্যাক্রে ক্যোর বাসিলিকা, নতর দামের মত ঐতিহাসিক ক্যাথেড্রালে মধ্যে একদিকে উপাসনা চলে অন্যদিকে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। আমি নিজেও পরিচিতজনদের নিয়ে অনেকবার এই বিখ্যাত গির্জা দুটি পরিদর্শন করেছি। গির্জা বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষদের প্রার্থনা কেন্দ্র হলেও ফ্রান্সের গির্জাগুলোর দরজা খোলা থাকে সকলের জন্য।এখানে কেউ প্রার্থনার জন্য যায় বিশেষ ভক্তি নিয়ে, কেউ যায় দেখতে।আমার কাছে মনে হয়েছে, এদিক থেকে ফ্রান্সের যীশুর অনুসারীরা এক ধর্মীয় উদারতার বিশেষ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রেখেছে। এছাড়া ফ্রান্সে যে সব ক্যাথলিক অর্থায়নের মানবিক সংস্থা রয়েছে সেসব সংস্থাগুলোতে যেসব দুস্থ মানুষ মানবিক সহায়তার জন্য যায় সেখানে ঐসব দুস্থ মানুষদের ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনা করে সেবা প্রদান করা হয় না, বরং ঐসব  মানুষের দুর্দশাকে প্রাধান্য দিয়ে সেবা দেয়া হয়, বিনিময়ে আর্তের নিকট কোন কিছু আশা করা হয় না। বিশেষ ধর্মীয় সংস্থা হলেও চাকুরীর ক্ষেত্রেও বিশেষ ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্ব পায়না।অর্থাৎ,হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টান, নাস্তিক সে যে বিশ্বাসের মানুষই হোক না কেন ঐসব প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতে পারে।  

অর্থায়নকারী ও সেবা প্রদানকারী ধার্মিক স্রষ্টার  সৃষ্টিকে সেবা প্রদানের মধ্যে ধর্মীয় আদর্শের মহত্ত্ব খুঁজে নেন।নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, এ ব্যাপারটিতেও ফ্রান্সের খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা মহানুভবতার দারুণ এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রেখেছে। যেমন, ছেকর ক্যাথলিক ইউরোপের বৃহত্তর ধর্মীয় মানবিক সংস্থা হলেও সংস্থাটি পরিচালনা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ ধর্মীয় রীতি নীতির ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায় না। মানবিক কাজে শুধুই মানবিকতাকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে ...... 

  











সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে,নদীর পাড়ে চলছে স্থানীয়দের বারবিকিউ পার্টি।বাতাস লোয়ার নদীর শীতল জল ছুঁয়ে খেলা করছে, বাতাসের তোড়ে বারবিকিউ চুলা জ্বলছে নিভু নিভু অবস্থা। চুলার ধোঁয়ার কুণ্ডলীর সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পোড়া মাংসের গন্ধ আর কয়লার ছাই।পাশেই বাচ্চাদের খেলার নানা উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।ছোট ছোট বাচ্চারা নির্মল আনন্দে খেলাধুলা করছে।এমন দৃশ্য দেখে মিশেল আমাদের ছেড়ে ছুটে গেলো খেলতে। আমরা কিছু সময় নদীর পাড়ে বসে সারাদিনের ক্লান্তি কিছুটা কাটিয়ে নিলাম।তার পর চলে এলাম বড় হাতির কাছে।



হঠাৎ করে হাতিটি দেখে একটি কাঠের ভাস্কর্য মনে হবে, আমি নিজেও ইন্টারনেটের ছবি দেখে তাই ভেবেছিলাম।কিন্তু কাছে এসে দেখলাম হাতির পায়ে চারটি চাকা লাগানো রয়েছে। এটি মূলত ভাস্কর্য আকৃতির একটি যান্ত্রিক চলন্ত হাতি।কাঠ ও ইস্পাতের তৈরি  ৪৮.৪ টন ওজনের শারীরিক কাঠামোর হাতিটি উচ্চতায় ১২ মিটার ,প্রস্থ ৮ মিটার এবং ২১ মিটার লম্বা। এছাড়া ঘণ্টায় ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ইলেকট্রিক শক্তিতে দৌড়াতে সক্ষম।যান্ত্রিক প্রাণীটির অভ্যন্তরীণ কাঠামো এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে উঁচু ভবনের পরিপাটি এপার্টমেন্টের মত।জীবন্ত হাতির পিঠে চড়ে অনেক শৌখিন মানুষ ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু  সিঁড়ি বেয়ে এই যান্ত্রিক হাতিটির পিঠে উঠে ও পেটের মধ্যে ঢুকে এক সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারে অনেক মানুষ।কারণ, মূল দেহটির মধ্যে শৈল্পিক সুনিপুণ ভাবে তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি কক্ষ সঙ্গে বারান্দা।কৌতূহলী বিনোদনপ্রিয় মানুষ টিকেট কেটে প্রবেশ করে এই যান্ত্রিক হাতির পেটে, কেউ ওঠে পিঠে। অগ্রভাগের ছোট্ট কক্ষে বসে এই যান্ত্রিক হাতির মাহুত দর্শনার্থীদের নিয়ে ঘুরে আসে লোয়ার নদীর ধার দিয়ে আশেপাশের কিছু এলাকা।প্রায় চার তলা ভবন থেকে বাইরের দৃশ্য যেমন দেখা যায়, এই হাতিতে ছওয়ার হওয়া দর্শনার্থীরাও নন্ত শহরের অবয়ব দেখতে পায় সে ভাবে।  
 









দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হাতিটি বিনোদন প্রিয় মানুষদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু আমরা যখন এসেছি তখন এই যান্ত্রিক জন্তুটি দিনের অবকাশ যাপন করছে। তাই আমাদের হাতির পেটে ঢুকে লোয়ার নদী দেখা হল না। আমরা বেশ কিছুক্ষণ বিস্ময় দৃষ্টিতে জন্তুটি পর্যবেক্ষণ করলাম, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম, তারপর  চলে এলাম লোয়ার নদীর স্রোতধারার কাছে।সূর্য ডোবার পূর্ব পর্যন্ত বহমান নদীর শান্ত স্রোতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাটল অকৃত্রিম কিছু আনন্দঘন মুহূর্ত।নদীটি শহরের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করলেও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পল্লব শাখায় ঢাকা কিছু প্রাচীন বৃক্ষ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে।এমন প্রকৃতি আমাদের সবার শরীর মনকে কিছু ক্ষণের মধ্যে শান্ত করে দিলো।মনে হচ্ছিলো গভীর রাত অবধি এই লোয়ার নদীর ধারে বসে নদীর কলধ্বনি শুনী। কিন্তু পরের দিন  আমরা যাবো আরেকটি শহরে। সেজন্য  প্রস্তুতি ও বিশ্রামের কথা ভেবে লোয়ারের তীরকে বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যার গোধূলি আলোয় ধীরে ধীরে সেতু পাড় হয়ে চলে এলাম এপারে। রাতের খাবার সেরে নিলাম রেস্তোরায়।ট্রামে চড়ে ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় রাতের শান্ত স্নিগ্ধ নন্ত শহর দেখতে চলে এলাম আমাদের যাযাবর গন্তব্যে……  

সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০

ফরাসি নাট্যমঞ্চে দ্যুতি ছড়াচ্ছে বাংলাদেশী নাট্য অভিনেতা সোয়েব মোজাম্মেল।

সোয়েব মোজাম্মেল, থিয়েটার ধ্যান জ্ঞান নিবেদিত প্রাণ এক নাট্য অভিনেতা।নিভৃতচারী এবং নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থেকে জীবনের প্রশান্তি খোঁজেন।১৯৮৮ সালে  ঢাকা’র  মুরাদপুরে এক সন্ধ্যায় নাটকের মহড়া দেখতে যায়, সেই মহড়ায় নাটকের শিশুশিল্পীর অনুপস্থিতে নাট্য নির্দেশক তাকে শিশুশিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করান।তার অভিনয় দেখে পরবর্তীতে তাকেই নাট্য নির্দেশক ঐ নাটকের শিশুশিল্পীর চরিত্রে মঞ্চে অভিনয় করান।সেখান থেকেই নাট্য মঞ্চে প্রথম যাত্রা। নাট্যমঞ্চের প্রেমে পড়ে  ১৯৯০ সালে যোগদেন চট্টগ্রাম শিশু থিয়েটারে। এরপর থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্যতম নাট্যদল  চট্টগ্রাম অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ে একজন নিয়মিত নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।নিজের পেশাগত কাজের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন নাট্যোৎসবে নাটক নিয়ে ঘুরেছেন বিভিন্ন অঞ্চল, কুড়িয়েছেন নাট্যমোদী মানুষের ভালোবাসা।বাংলাদেশে তার অভিনীত ও প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে,এসো দেশ গড়ি, ভোট পাগলা,অদ্ভুত ভূত, চিচিঙ্গে  এন্ড কোং, এই পিরীতি সেই পিরীতি নয়, সাজন মেঘ, তাইরে নাইরে না,  ভবঘুরে, চক্রবৃদ্ধি,মীন কন্যা, মেঘের ভেলা, কালোচাঁদ উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে দেশ ছেড়ে চলে আসেন শিল্প সংস্কৃতির তীর্থভূমি  ফ্রান্সে।শেকড়হীন বিভূয়ে শুরু হয় নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম।নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটলেও ছুড়ে ফেলতে পারেনি শিল্পের নেশা,বরং আরও যত্নে আগলে ধরছেন।এখন জীবন সংগ্রাম এবং শিল্পই যেন তার জীবন।  

এখানে আসার পর পরিচয় হয় সমাজকর্মী প্রদীপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে।তিনিই প্রথম তাকে ফরাসি মঞ্চে অভিনয় করার জন্য অনুপ্রেরণা ও নানাভাবে সহযোগিতা করেন।


বিভিন্ন সময়ে ফরাসি দেশের  নানা  উৎসবে ভিনদেশী মানুষদের নিকট তুলে ধরেছেন দেশীয় লোকজ শিল্প লাঠি বাড়ি  খেলা। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ফ্রান্স সংসদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের সুন্দর রক্ষা আন্দোলনের তাৎপর্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার জন্য করেছেন একক পথ নাটক। 


দৃঢ় সংকল্প ,কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম মাধ্যমে সোয়েব মোজাম্মেল এখন স্থান করে নিয়েছেন  ফরাসি নাট্য মঞ্চে। নাট্য নির্দেশক মারি লামাশের (Marie Lamachère) নির্দেশনায় এ বছর জানুয়ারি মাসে ফ্রান্সের মনপেলিয়ে (Montpellier) শহরে মঞ্চস্থ হয়  নাট্যকার বারবারা মেতের ( Barbara Métais) নাটক দো কোয়া ইয়ের ছোরা ফে( De quoi hier sera fait) ।এই নাটকটির মাধ্যমে বাঙালি নাট্য অভিনেতা শোয়েব মোজাম্মেল প্রথম ফরাসি মঞ্চে পা রাখেন। প্রথম নাটকেই অভিনয় দক্ষতা দেখিয়ে তিনি মন জয় করে নেন ফরাসি দর্শকদের। বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট বাণিজ্য , শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্রাণ প্রকৃত ও পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মানব সভ্যতা কতটা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে তারই বাস্তব চিত্র নাটকটিতে ফুটে উঠেছে।উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশ, কানাডা, ফ্রান্স,আলজেরিয়ার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।নাটককে জীবন্ত করে ফুটে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় বাংলা, ফরাসি, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষা।এই নাটকে  সোয়েব মোজাম্মেল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে একজন উদ্বাস্তু বাঙালির ভূমিকায় অভিনয় করেন। নাটকের অনেক অংশে তার মুখে শোনা যায় বাংলা ভাষায় উচ্চারিত সংলাপ। পরবর্তীতে নাটকটি  রাজধানী প্যারিস শহরে মঞ্চায়ন হয়। ফ্রান্সের অন্যান্য শহরে নাটকটি মঞ্চায়নের পরিকল্পনা থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে থেমে আছে। 



ফ্রান্সে  বাঙালিদের শিল্প সংস্কৃতি চর্চা সাধারণত কমিউনিটি ভিত্তিক, কিন্তু ফরাসি মূল ধারার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে যারা নিজেদেরকে যুক্ত করেছেন তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। সোয়েব মোজাম্মেল সেই কয়েকজন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। 

একজন নাট্যশিল্পী হয়ে ওঠার জন্য শোয়েব মোজাম্মেল কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন নাট্যনির্দেশক অ্যাডভোকেট এনামুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, আমিনুল ইসলাম মুকুল, আকবর রেজা,শিশির দত্ত সহ অনেক গুণীজনের কথা। যাদের সান্নিধ্য,পরামর্শ  ও দিকনির্দেশনা তাকে নাট্যধ্যানী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।এছাড়া ফরাসি মঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ভাষাগত সমস্যায় সবসময় পাশে পেয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসনাত জাহানকে।  



ফরাসি মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি  ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলা আবৃত্তি শিল্পীদের নিয়ে সোয়েব মোজাম্মেল নিয়মিত আয়োজন করেন কবিতা পাঠের আসর।  


বাংলাদেশের  অনেক গুণী শিল্পী এখন ফ্রান্সে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন কিন্তু সঠিক দিক নির্দেশনা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ফরাসি মূলধারার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চান না।

সোয়েব মোজাম্মেল যেন সেই সব প্রতিভাবান শিল্পীদের নিকট এক দ্যুতিময় ধ্রুবতারা, এক অনুপ্রেরণা।বাংলাদেশ থেকে আসা প্রত্যেক নাট্যজন একদিন এক একজন সোয়েব মোজাম্মেল হয়ে ফরাসি মঞ্চে  আলো ছড়াবে, সেটাই  প্রত্যাশা। ফরাসি নাট্যমোদী দর্শকরা ভাববে, ফ্রান্সে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষ শুধু অর্থ উপার্জনের জন্যই আসে না, কেউ কেউ শিল্পের সৌন্দর্যে মোহিত করতেও আসে।  


শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা।

ধর্ষণ বাংলাদেশের একটি দীর্ঘদিনের সংক্রমিত সামাজিক সমস্যা । বিভিন্নজন এটিকে বিশেষ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। কিন্তু এটি ঘুস, দুর্নীতি,লুণ্ঠন, চুরি, অপহরণ, হত্যা,কালোবাজারি মত অনন্যা অপরাধের মতই একটি সামাজিক অপরাধ।যা রাষ্ট্রের বল্গাহীন অনিয়ম অব্যবস্থার কারণে অন্যান্য অপরাধ যেভাবে সংগঠিত হয় এটিও তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। 


আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় নীরবে  নিভৃতে প্রতিদিন কেউনা কেউ ধর্ষিত হয়। কিন্তু কারও ঘটনা যখন প্রকাশ্যে চলে আসে তখন আমরা প্রতিবাদমুখর হই।রাজপথে ধর্ষণ বিরোধী প্রতিবাদী শ্লোগান দেই, ফেচবুকে নিজের মত করে প্রতিবাদ জানাই। বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ বিভিন্ন  দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণের কারণ, প্রতিরোধ নিয়ে মতামত দেই।এই মতামতগুলো মূলত একান্তই প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জীবন যাপন ও বিশ্বাস নির্ভর।গবেষণা নির্ভর ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।আমাদের সমাজে  ধর্ষণের জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে দায়ী করে থাকি, কখনো নারীর আধুনিক জীবন যাপনকে দায়ী করি, নারী স্বাধীনতাকে দায়ী করি, ধর্মীয় বিধিবিধান বহির্ভূত জীবন যাপনকেও সমাজের বড় অংশ অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।অনেক সময় একটি ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসলে অনেক সময় ধর্ষকের অপরাধকে গৌণ মনে করে  উল্লেখিত কারণ সামনে এনে ধর্ষিত নারীর দিকেই আঙ্গুল তোলা হয়।দেশের নারীবাদীদের বড় অংশ পুরুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সরাসরি পুরুষের বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা বা মনোবৃত্তিকে ধর্ষণের প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করে থাকে।কোন এক সময় আমি নিজেও ধর্ষণের কারণ হিসেবে অন্যান্যদের মত করেই ভাবতাম। কিন্তু এখন ধর্ষণের উল্লেখিত কারণগুলোর একটিকেও মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করি না।    

নারী পুরুষের শত্রু নয়, পুরুষ নারীর শত্রু নয়।নারী ধর্ষিত হলেই পুরুষকে নারীর শত্রু ভাবা একটি উন্মাদ চিন্তা । নারী পুরুষ মিলেই সমাজ রাষ্ট্র এবং পৃথিবী। দিন শেষে পুরুষ নারীর কাঁধে মাথা রেখে জীবনের প্রশান্তি খোঁজে, নারীও একজন পুরুষের মাঝে খোঁজে জীবনের সুখ।ধর্ষণ মূলত একটি অপরাধ। সেটিকে শুধু অপরাধ ভাবাই উত্তম। সেই অপরাধ নির্মূলের জন্য ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য নারী পুরুষের হাতে হাত রেখে প্রতিবাদ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা অপরিহার্য।   


ধর্ষণ হচ্ছে সবল কর্তৃক দুর্বলের উপর নির্মম বর্বরতা,একজন মানুষের নিজের মত বেঁছে থাকার স্বাধীনতার উপর আগ্রাসন।আমাদের সমাজে এমন বর্বরতা সর্বনিম্ন স্তরের মানসিকতা সম্পন্ন শারীরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে সবল মানুষদের দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে।এটি রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। একজোড়া নারী পুরুষ সামাজিক,রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নিয়ম মেনে একে ওপরের সম্মতিক্রমে ও ইচ্ছের পোষণ করে যৌন সঙ্গমে মিলিত হওয়া মধ্যে সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। এই কর্মটি যখন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নিয়ম উপেক্ষা করে কারো উপর বলপূর্বক ও জোরজবরদস্তি করে করা হয় তখনই এটি ধর্ষণ। ধর্ষণ শুধু নারীই হয়না,স্থান ভেদে পুরুষও হয়, কখনো স্বয়ং রাষ্ট্রও ধর্ষণের স্বীকার হয়।তবে যে রাষ্ট্র নিজেই ধর্ষণের স্বীকার সেই রাষ্ট্রের প্রতিটি নারী পুরুষ প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে এবং ধর্ষণের স্বীকার হবে, এটা  অস্বাভাবিক নয়।একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি বিশৃঙ্খলার পেছনে একটি সূত্র থাকে সেই বিশৃঙ্খলার নাভিমূলে পৌছুতে না পারলে এবং সেই সূত্র অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, দুই একটি ঘটনার দেখানো বিচার করে এবং কঠোর আইন বানিয়ে এর স্থায়ী সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। 

নিয়ম বহির্ভূত বলপূর্বক যৌনসঙ্গমকে যদি ধর্ষণ বলা যায় তাহলে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অসম্মান করে  বলপূর্বক রাষ্ট্র ক্ষমতা লুণ্ঠন করাকে রাষ্ট্র ধর্ষণ বললে খুব অসঙ্গত হবে বলে আমি মনে করি না। 


আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই ধর্ষণসহ নানা ধরণের অত্যাচারের স্বীকার হয়।পুরুষ ধর্ষণের আনুপাতিক হার উল্লেখ করার মত নয় । আমাদের প্রথমেই জানা দরকার, আমাদের সমাজে নারীরা কেন ধর্ষণ ও অত্যাচারের স্বীকার হয় ? 

 আমাদের দেশের নারীদের পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বা শাসিত সমাজের মধ্যে বসবাস।দেশের অধিকাংশ নারী পুরুষের মুখাপেক্ষী ও আর্থিক ভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। ফলে আমাদের দেশের নারীরা মানসিক ভাবে দুর্বল। তাকে বাঁচতে হলে অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে বাঁচতে হবে, এই মানসিকতা নিয়েই দেশের অধিকাংশ নারীকে ছোট থেকে বেড়ে উঠতে হয়।এমন সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশের অধিকাংশ পুরুষের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত নয়। তারা নারীকে দুর্বল মানুষ ভেবে থাকে।এর বড় কারণ নারীর প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি ও আইন কানুন তার অনুকূলে নয়। 

দেশের অনেক শিক্ষিত গৃহিণী নারী রয়েছে যারা আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী নয় অর্থাৎ স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল।এমন নারীরা  যখন বিভিন্ন কারণে স্বামীহীন হয়ে পড়ে তখন নিজের ও বাচ্চাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব ঐ নারীর ঘাড়ে এসে পড়ে।আমাদের দেশে ইচ্ছে করলেই মধ্য বয়সের শিক্ষিত নারীর চাকুরী বা কাজের সুযোগ নেই।অনেক চাকুরীর ক্ষেত্রে একজন নারীর শিক্ষা ও যোগ্যতার চেয়ে তার শারীরিক সৌন্দর্য ও বয়সকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এমন ক্ষেত্রগুলোতে যোগ্যতা থাকলে একজন বিপদগ্রস্ত  মধ্য বয়সী নারীকে কাজের সুযোগ দেয়া হয় না। স্বাধীন ভাবে কিছু করার জন্য যে অর্থ দরকার সেটাও যাদের নেই। এমন নারীদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সৎ উপায়ে কিছু করার জন্য পরিবার ও সমাজের অনেকের কাছে দ্বারস্থ হতে হয়। এমন অনেক শিক্ষিত নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সমাজের অনেক মুখোশধারী সাধু মানুষদের দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হতে হয়।যা লোকলজ্জা ও ভয় ভীতির কারণে এই অন্যায়কে মেনে নিয়ে মুখবুজে জীবন যাপন করতে হয় অনেক নারীর। 

তাছাড়া, প্রাইভেট সেক্টরের চাকুরীর ক্ষেত্রগুলোতে একজন কর্মীর চাকুরী থাকা না থাকা নির্ভর করে  প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি ও মালিকদের ইচ্ছে অনিচ্ছার উপর।কোন কর্মী যদি কোন কারণে চাকুরী হারায় তাহলে বেকার কালীন সময়ের এই সেক্টরের কর্মীদের জন্য রাষ্ট্রের কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নাই।বড় ধরনের এই অনিশ্চয়তা এই সেক্টরের শিক্ষিত নারী কর্মীদের নিভৃতে যৌন হয়রানির ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে।

দারিদ্র্যতার কারণে অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে অনেক মেয়েকে গৃহকর্তা কর্তৃক ধর্ষণ এবং গৃহকর্ত্রী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়।এমন শ্রেণীর নারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকায় পেটের প্রয়োজনে যাবতীয় অন্যায় সহ্য করেই কাজ করতে হয়। 

সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নারীর শরীরটাই যেন নারীর পরাধীনতা,নিজের মত করে  জীবন যাপনের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।সমাজের চার পাশের শিয়াল শকুন মনোবৃত্তির মানুষদের শ্যেন দৃষ্টির মধ্যেই তাদের জীবনের যাপন করতে হয়। এমন নারীরা নির্যাতনের স্বীকার হলেও সামাজিক অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে পারে না, কেউ দ্বারস্থ হলেও তার সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের কারণে বিচারের রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী অপরাধীর পক্ষে যেতে দেখা যায়। 

তৃনমূল নারীদের দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ করতে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়েও যৌনদাসীতে পরিণত হয়ে নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে প্রতিনিয়ত দেশে ফিরে আসে আমাদের বাংলাদেশের নারীরা। 

আমাদের যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো তা জন্মগত ভাবেই একজন নারীর স্বাধীন ভাবে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার প্রতিকূলে।   


 বর্তমানে দেশের এক শ্রেণীর যুব সমাজের নৈতিকতার অবক্ষয় চূড়ান্ত শিখরে।দেখা যায় এদের মাথার উপর বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা,এরশাদ, খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমানের ছবি, এই যুব সমাজ রাজপথে উল্লেখিত ব্যক্তিদের আদর্শ মেনে স্লোগান দেয়।যাদের মাথার উপর রাষ্ট্রের এতো বড় বড় ব্যক্তিবর্গের ছবি, যারা তাদের আদর্শ ,তাদেরতো সমাজের নিপীড়িত মানুষের সেবক হওয়ার কথা। অথচ এমন যুবকদের দেখা যায়  নারী ধর্ষণ,মানুষ হত্যা সহ সমাজের অনৈতিক কাজের এমন কোন কর্ম নেই যে তাদের দ্বারা সংগঠিত হয় না।কেন এমন অনৈতিক কর্ম তাদের দ্বারা সংগঠিত হয়? রাষ্ট্রের আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে কোথা থেকে তারা এমন অনৈতিক কাজের সাহস পায়?অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসে।


আমাদের দেশের সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি উল্লেখ রয়েছে, অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, মূলত এই চারটি নীতির একটিরও বাস্তবতা নেই। কাগজে কলমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হলেও শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো বাস্তবে বিদ্যমান নয়।দেশে রাজনৈতিক বড় যে দলগুলো  রয়েছে সেখানে প্রকৃত রাজনৈতিক আদর্শ চর্চা হয়না।কারণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের জন্য জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয় আপামর জনগণের স্বার্থে কাজ করার মধ্য দিয়ে।জনগণ যে দলকে তাদের পক্ষের শক্তি মনে করবে তাদেরকে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্পণ করবে।আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় কোটি কোটি টাকা খরচের নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা বিদ্যমান থাকলে জনগণের ভোট দেবার সুযোগ নাই।ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় ব্যালট ডাকাতির মাধ্যমে।এই ব্যালট ডাকাতিতে যে দল  পেশী শক্তি,অপকৌশল,অসততা, নীতিহীনতা,মিথ্যাবাদিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যত এগিয়ে থাকবে রাষ্ট্র ক্ষমতা তার হাতে কুক্ষিগত হবে।এই বিষয় গুলো মাথায় রেখেই রাজনীতিতে বিনিয়োগকারী বড় বড় দলের নেতারা দেশের যুব সমাজের বৃহৎ একটি অংশকে তাদের ব্যবহারের স্বার্থে নীতি বিবর্জিত করে গড়ে তোলে।


আজ রাজনৈতিক পরিচয়ের যে ছেলেটিকে ধর্ষণের দায়ে ঘৃণা করছি, গালি দিচ্ছি, তার শাস্তি চেয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ সভার মাধ্যমে বিচার প্রার্থনা করছি  প্রশ্ন?  কার কাছে বিচার প্রার্থনা করছি ?  রাষ্ট্রের অধিপতির চেয়ারে বসা  যাদের কাছে বিচার প্রার্থনা করছি, ঐ চেয়ারে বসা অধিপতি কি আমাদের? আমরা কি তাদের অধিপতি বানিয়েছি ? ঐ অধিপতির চেয়ার ছিনিয়ে আনতে দলের তৈরি নীতি বিবর্জিত যুবক ছেলেগুলোই ব্যালট ডাকাতিতে অংশ নেয় জীবন বাজী রেখে।এমন পরিশ্রমের অর্জনে যে রাষ্ট্র ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার যথেচ্ছা  ব্যবহারের স্বাদ কারই না জাগে।তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনিয়ে আনার পর ওদের মনের মধ্যে বীরের অনুভূতি জেগে বসে।একটু আরাম আয়েস করা ওদের প্রাপ্য অধিকার বলে মনের মধ্যে উঁকি দেয়।দলের ক্ষমতার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ওরা মাদক ব্যবসা করে, চাঁদাবাজী করে,খুনখারাপি করে,কোন মেয়েকে ধর্ষণের ইচ্ছে জাগলে বন্য জানোয়ারের মত প্রকাশ্য দিবালোকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।ওরা মনে করে, দেশের সাধারণ মানুষ ওদের ক্ষমতার দাস। মধ্যযুগের দাসদের যেমন মুনিবের ক্ষমতার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে যথেচ্ছা ব্যবহার হতে হতো, তেমনি বাংলাদেশর মানুষ আজ বর্বর রাজনৈতিক শক্তির বৃত্তে বন্দী হয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খলে দিন যাপন করছে। 


একটি দেশের নিয়মতান্ত্রিক ও সুসভ্য রাজনৈতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক শৃঙ্খলা।এই ভিত্তির উপর  নির্ভর করে সমাজের বিবর্তন।সেই বিবর্তনে গড়ে উঠতে পারে একটি সুসভ্য সমাজ ব্যবস্থা ও আপামর মানুষের উন্নত মানুসিকতা। অন্যথায় সমাজ ধাবিত হবে বর্বরতার দিকে। আমরা আজ আমাদের সমাজের বিবর্তনের যে প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি তাতে খুব সহজেই অনুমেয় কেমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা অতিবাহিত করছি।    


 আমরা একটি রক্ষণশীল সমাজের মানুষ।পরিবার ও সমাজ নির্ভর আমাদের জীবন।যৌথ পরিবার ব্যবস্থা  প্রায় বিলুপ্তির পথে।এক সময় যৌথ পরিবারের সম্পদ ও সকলের উপার্জন এক হাতে থাকত। পরিবারের সম্পদ রক্ষা, কাজকর্ম,পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে  অনেক বেকার ছেলেকে বিবাহ দেয়া হতো।পরিবারের সামগ্রিক আয়ের উপর ভর করে ওই বেকার বিবাহত  ছেলে স্বাবলম্বী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিবাহিত দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারতো।যুগের বিবর্তনে এখন গড়ে উঠেছে একক পরিবার। আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের এক মাত্র বৈধ পন্থা হচ্ছে বিবাহ।বিবাহ করতে হলে একজন পুরুষকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে হয়।অর্থাৎ বিবাহ করতে হলে পরিবার পরিচালনার আর্থিক সক্ষমতা তাকে অবশ্যই অর্জন করতে হবে।তা নাহলে সাধারণত একজন বেকার পুরুষ বড় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভালোগুণের অধিকারী হলেও তার সঙ্গে আমাদের দেশের মেয়ে পরিবারগুলো বিবাহ দিতে সম্মত হয়না এবং এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে দেশের কর্মসংস্থান একেবারেই অপ্রতুল।অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্র ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা শাসকদের দেশের অর্থনীতির সমবণ্টন,বেকার সমস্যার মত ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ও প্রকল্প লক্ষণীয় নয়।যা রয়েছে তা লোক দেখানো। যে সব প্রকল্প হাতে নেয়া হয় সেগুলো মূলত মহৎ উদ্দেশ্যে নয় বরং ঐ প্রকল্পকে ভিত্তি সরকারের দায়িত্বশীলদের ব্যক্তিগত অর্থ লোটার মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহারের জন্য।দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকালীন সময় জুড়ে ব্যস্ত থাকতে হয় ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘ করার মাস্টার পরিকল্পনা নিয়ে এবং তাদের সময় কাটে রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের তাড়াহুড়ার মধ্যে।সৎ পথে  সারা জীবন ব্যবসা ও চাকুরী করে এক কোটি  টাকার মালিক হওয়ার  হিসাব মেলানো যায়না অথচ শূন্য হাতে রাজনীতির করতে এসে বা রাজনীতির সংস্পর্শে গিয়ে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে এক সময়ে অন্যের কাছে চেয়ে খাওয়া ভবঘুরের শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার নজির আমাদের সমাজে ভূরি ভূরি।ক্ষমতার কল্যাণে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতা ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশের আগেই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়।এই হল আমাদের দেশের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক বাস্তবতা। এমন বাস্তবতায় সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্য যেমন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে,এর প্রভাবে  বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের  উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ভোগবাদী মানুসিকতা।ফলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সমাজে এখন একজন মানুষের সামাজিক মূল্যায়ন তার শিক্ষা, সততা ও মানবিক গুণাবলীর উপর নির্ভর করেনা, নির্ভর করে আর্থিক মানদণ্ডে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ফলে বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে একজন ছেলের শিক্ষা,সৎ উপার্জন ,মহৎ গুণাবলীর চেয়ে গুরুত্ব পায় তার দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণ।সেই সম্পদ কি উপায়ে উপার্জিত তা বিচার বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়না। ন্যায় অন্যায় বিবেচনাবোধ আমাদের সমাজ থেকে আজ বিলুপ্তির পথে হাঁটা ধরেছে।নীতি বিবর্জিত মানসিকতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে সমাজে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ।এমন সামাজিক বাস্তবতায় দীর্ঘদিনের চলে আসা নিয়ম ও দৃষ্টিভঙ্গির  পরিবর্ত আনা সময়ের দাবী বলে মনে করি। আমাদের দেশে নারী উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে।পুরুষদের পাশাপাশি শিক্ষাদীক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীরা তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে।পড়াশুনা শেষ করা অনেক নারীকেই এখন স্বাবলম্বী দেখা যায়।যা আমাদের সামাজিক অগ্রগতির বড় এক অর্জন এবং অনুপ্রেরণা। একজন মেয়ে আত্মনির্ভর বা স্বাবলম্বী হলে বিবাহের ক্ষেত্রে তার থেকে উচ্চ পদমর্যাদা বা বেশী যোগ্য ছেলে খুঁজতে হন্য হতে হয়। এমন ছেলে না পাওয়া গেলে বিবাহের সময় ক্ষেপণ করতে করতে অনেক সময় এমন নারীদের বিবাহের উপযুক্ত বয়স পেড়িয়ে যায়।মানুষের জৈবিক চাহিদা সহজাত।বিবাহের উপযুক্ত হওয়ার জন্য বা উপযুক্ত পাত্র পাত্রী পাওয়ার আশায় পেছনে যে সময় নারী পুরুষ অতিবাহিত করে সেই সময়টায় হয়তো তারা ব্যক্তিগত ভাবে জৈবিক কষ্ট স্বীকার করে জীবন যাপন করে, নতুবা গোপনে বিকল্প পন্থায় জৈবিক চাহিদা পূরণ করে। একটি বিবাহবদ্ধ শৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য যেহেতু একটি উপার্জনের উৎস দরকার এ ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারা বা প্রথার ছেলের ভূমিকায় একজন মেয়ে যদি অবতীর্ণ হতে শুরু করে তাহলে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যেতে পারে। অর্থাৎ, একটি শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়ে তার চেয়ে যোগ্য ছেলে পাওয়ার আশায় জীবনের সীমিত সময়ের মূল্যবান দিনগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে জৈবিক চাহিদার যে ত্যাগ স্বীকার করে, তা না করে  একজন শিক্ষিত,সৎ ও চরিত্রবান বেকার ছেলেকে বিয়ে করে বিবাহিত সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের মাধ্যমে জীবনর মূল্যবান সময়গুলো উপভোগ করতে পারে। একজন সুশিক্ষিত সৎ মানুষ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হয়ে থাকে। এমন মানুষ সময়ের বাস্তবতায় কারো সহযোগিতা নিলেও সারা জীবন কারো উপর নির্ভরশীল হয় না। সে নিজে কিছু একটা করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে।পৃথিবীতে কেউ স্বাবলম্বী হয়ে জন্মগ্রহণ করেনা।দীর্ঘ চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে হয়, তবে সেই কঠিন  পথে যদি কেউ একটু সহযোগিতার কোমল হাত বাড়িয়ে দেয় তবে পথটা আরও মসৃণ হয়ে যায়। 


আমাদের দেশে যৌনতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়,সামাজিক ও ধর্মীয় কঠোর বাধ্যবাধকতার বিপরীতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কর্মহীনতা ধর্ষণের মত সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ সৃষ্টি করছে তা অস্বীকার করার নয়।                


মানুষ মূলত জন্মগত ভাবে সাধু হয়ে জন্মায় না, আবার অপরাধী হয়েও জন্মায় না। অন্যান্য প্রাণীর মতই একটি জীবন নিয়ে দেহসর্বস্ব অতি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে জন্মায়। জন্মের পর থেকে তার মস্তিক ধীরে বিকাশ লাভ করতে থাকে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও শিক্ষার মাধ্যমে। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে চলমান রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে একজন মানুষের নীতি নৈতিকতার বিকাশ লাভের ক্ষেত্রে।মানুষ মাত্রই প্রত্যেকের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই রিপুগুলো বিদ্যমান। আবার এই মানুষই দেবত্ব গুনের অধিকারী।একজন মানুষ অতি সহজেই ভেতরের পশুত্বকে বর্জন করে দেবত্ব গুনের অধিকারী হতে পারে না।তাকে সাধনা করতে হয়। তবে পৃথিবীতে কিছু মানুষ প্রবল মানবিক গুনের অধিকারী হয়।রাষ্ট্রীয় আইন কানুনের বাধ্যবাধকতা,নীতি নৈতিকরা ও ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসরণ ছাড়াই এমন বিশেষ গুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রখর কাণ্ডজ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির  অধিকারী ছাড়া এমন মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। সমাজের অধিকাংশই মানুষই স্বাভাবিক  প্রবৃত্তি সম্পন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ তার সামনে কাম বাসনা বা কোন নিষিদ্ধ আনন্দ পূরণের সুযোগ আসলে বা পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সে বৈধ অবৈধ নীতি নৈতিকতার বোধ হারিয়ে তার প্রবৃত্তি পূরণের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে।হোক সে নারী অথবা পুরুষ। উদাহরণ স্বরূপ, যখন কোথায়ও যুদ্ধবস্থা বিরাজ করে তখন সেই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশী অনিরাপদ হয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার পুরুষ সৈনিকদের দ্বারা নারী ধর্ষণের ঘটনা এবং নারী সৈনিক দ্বারা নিরীহ পুরুষ ধর্ষণের দৃশ্য।সৈনিকদের মূলত যুদ্ধ করার কথা ছিল প্রতিপক্ষ সৈনিকদের সঙ্গে, আঘাত আনার কথা ছিল প্রতিপক্ষ ঘাঁটিতে। নিরীহ নারী পুরুষদের ধর্ষণের দায়িত্ব নিয়ে তারা রণাঙ্গনে আসেনি। অথচ তারা উন্নত দেশের সুশিক্ষিত সৈনিক।তাহলে কেন এমন কর্ম তারা করলো? একটি দেশ যখন যুদ্ধাবস্থায় থাকে তখন দেশের আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। জনগণের  প্রতিরক্ষার  প্রতিটি সংস্থা কার্যকারিতা হারায়।অর্থাৎ নিরীহ মানুষের পাশে এমন কেউ থাকে না যারা তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।এমন পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সৈনিকের সামনে নিরীহ মানুষের জান এবং মাল অধীন হয়ে যায়।অনেক সৈনিক হারিয়ে ফেলে তার নীতি নৈতিকতার বোধ ও মানবিকতা।তার ভেতর জেগে ওঠে আদিমতা, তাই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নিরীহ নারী,পুরুষ এবং শিশু হয়ে ওঠে আদিম কামনা বাসনা পূরণের খেলনা। পৃথিবীর যে কোন যুদ্ধাঞ্চল এই বিশৃঙ্খলার বাইরে নয়। 

আমরা জানি ধর্মীয় গুরুরা মানুষের নীতি নৈতিকতার পথ দেখায়, শান্তির কথা বলে অথচ অনেক পাদ্রী,পুরোহিত,সন্ন্যাসী, মোল্লা দ্বারা নারী ধর্ষণ ও শিশু কিশোর বলৎকার হওয়ার ঘটনা যুগে যুগে কম হয়নি।যা এখনো বিদ্যমান।  

সমাজে রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে পাশাপাশি যে বন্ধুর হাতে হাত রেখে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত পথ হাঁটা হয়েছে  মাইলের পর মাইল, সেই বন্ধুর দ্বারাই ধর্ষণের স্বীকার হওয়ার নজিরও রয়েছে।

অর্থাৎ সাধুর লেভাজ দেখলেই একজন মানুষকে সাধু ভাবা অযৌক্তিক।কারণ লেভাজেের ভেতরে মানুষ আকৃতির দেহে বসবাস করা পশু কতটা জাগ্রত আর কতটা সুপ্ত সেটা অন্যের বোঝার কোন পরিমাপ যন্ত্র নেই।একজন মানুষের ভেতরে প্রকৃতই কি খেলা করে তা শুধু সেই মানুষই জানে।তার চেহারা বা লেভাজ দেখে কিছু বোঝা সম্ভব নয়।  


দেশে বাস্তব জীবনে এমন বেশ কিছু বাস্তবতা দেখার সুযোগ হয়েছে।একবার এক বন্ধুর কাছে একটি গল্প শুনেছিলাম, বাস্তব গল্প ।

একবার একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অফিসে সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা যোগদান করলেন।বিশেষ একটি রুমে আধুনিক চেয়ার টেবিল কম্পিউটার দিয়ে তার কার্যালয় সাজানো হল।দুই তিনজন সিনিয়র কর্মকর্তা ব্যতীত ঐ অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তা কর্মচারী সদ্য শিক্ষা জীবন শেষ করা বয়সে তরুণ। এতো বড় কর্মকর্তার আগমনে অফিসের তরুণ কর্মীরা বেশ খুশী।সরকারের এত বড় কর্মকর্তা যে সরকারি চেয়ারে থাকা অবস্থায় সাধারণত এমন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করা সাধারণ মানুষের জন্য দুরূহ ব্যাপার।অফিসের তরুণ কর্মীরা এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে কাজ করতে পেরে বেশ উজ্জীবিত।তিনিও তরুণদের সঙ্গে বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ করেন।মাঝে মাঝে অনেকের সঙ্গে খোলামেলা গল্পও করেন,চাকুরী জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।অনেক সময় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হলে সবাইকে তার রুমে ডেকে এক সাথে খেলা দেখেন।এমন বন্ধুসুলভ আচরণে  অফিসের তরুণ কর্মীরা তাকে  ফেরেশতার মত  শ্রদ্ধা করে।তার বিগত চাকুরী জীবনে সততার খুব সুনাম রয়েছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির অফিসে তার মূলত নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই।তিনি অফিসে আছেন এটা জেনে সবাই যার যার টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে আর সরকারি অফিসে কোন সমস্যা হলে তিনি সেই অফিসের কর্তাকে ফোন করে বলেন আমি অবসর প্রাপ্ত , এই কোম্পানির পদে আছি, আমাদের কোম্পানির ফাইলটা আটকে আছে যদি একটু দেখতেন।তবে নিজ অফিসের প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের কোন ফাইল বা বিল ম্যানেজিং ডিরেক্টরের টেবিলে যাওয়ার পূর্বে তাকে দেখানোর নির্দেশ রয়েছে।অফিস টাইমে বেশির ভাগ সময় সে তার রুম বন্ধ করে অবস্থান করেন।অভ্যর্থনায় কর্মরত মেয়েদের মাঝে মাঝেই তার রুমে ডেকে দীর্ঘ সময় অফিস পরিচালনার নিয়ম কানুন,শৃঙ্খলা সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।অভ্যর্থনার মেয়ে কর্মীরাও তার খুব ভক্ত।তার অতি ভালোবাসায় অনেক সময় অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তাদের কোন প্রয়োজন অভ্যর্থনা কর্মীদের  কাছে গুরুত্ব পায় না।বড় কর্তার বাসা অফিসের পাশেই, অফিস টাইমে হঠাৎ হঠাৎ তিনি তার রুমে থাকেন না।বাসায় চলে যান।ইঞ্জিয়ারিং, মার্কেটিং,প্রকিউরমেন্ট,হিসাব বিভাগের সব কর্মকর্তারই বিভিন্ন প্রয়োজনে মাঝে মাঝে তার রুমে যেতে হয়।একদিন একটি প্রোজেক্টের ডিজাইন দেখানোর জন্য  এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার তার রুমের দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো,ভেতরে ডুকে দেখল তিনি তার চেয়ারে নেই।ভাবল ফাইলটা তার টেবিলে রেখে আসলে তিনি যখন অফিসে ফিরবেন তখন ডিজাইনটা দেখতে পাবেন।ডিজাইনের ফাইলটি টেবিলে রাখতে গিয়ে তরুণ ইঞ্জিনিয়ার যা দেখলেন তা অবিশ্বাস্য।বড়কর্তার ডেস্কটপে ভেসে আছে পর্ণ ওয়েবসাইটের রগরগে দৃশ্য।এই দৃশ্য দেখে তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বাস করেনি এই কাজটি বড় কর্মকর্তার।বয়সে প্রবীণ, তাছাড়া তিনি ইন্টারনেট, কম্পিউটার ব্যাবহারেও পারদর্শী নয়।তাছাড়া তার কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংক্রান্ত কাজে সাহায্যের জন্য মাঝে মাঝেই অফিসের তরুণ কর্মীদের তার রুমে ডেকে নেন।অফিসে দুইটি গ্রুপ রয়েছে।এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের প্রতিপক্ষ। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার তার নিজের গ্রুপের বিশ্বস্ত এক কর্মকর্তার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলো। তার ধারণা, বড়কর্তা যখন তার অফিস রুম ছেড়ে বাসায় যায় তখন অন্যগ্রুপের বিশেষ একজন তরুণ কর্মকর্তা তার রুমে ডুকে পর্ণ সাইট দেখে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সন্দেহ খুব গাঢ় অন্যগ্রুপের নির্দিষ্ট ঐ তরুণ কর্মকর্তার প্রতি।সে ভাবছে, এমন এক সম্মানিত ব্যক্তির অফিস কক্ষে ডুকে এমন কাজ গর্হিত অপরাধ, ঐ দিন স্যার যদি কক্ষে প্রবেশ করে এই অবস্থা দেখত তাহলে অফিসের সবাইকে কি ভাবতো! অফিসের তরুণদের প্রতি তার যে ভালো ধারণা সেই বিশ্বাস ও ভালোবাসায় ফাটল ধরত। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার অন্যগ্রুপের স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন এক তরুণ মার্কেটিং কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালো সত্যতা উন্মোচনের জন্য। মার্কেটিং কর্মকর্তা নিজ গ্রুপের সন্দেহভাজন কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি খুলে বলল,এবং জানতে চাইলো সে এই কাজ করে কিনা। বিষয়টি জেনে সন্দেহভাজন তরুণ উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে এই ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটনের চাপ সৃষ্টি করলো। কারণ, তাকে সন্দেহ করায় সে অপমানবোধ করেছে। সত্য উদঘাটনের জন্য দুই গ্রুপের মধ্যে সমযথা হল।দুইগ্রুপের দুই জন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দায়িত্ব দেয়া হল প্রকৃত সত্য উন্মোচনের জন্য।এদের দুজনই আইটি জ্ঞানে পারদর্শী।বড়কর্তা তার রুম ছেড়ে গেলে কখনো রুম লক করে যায় না। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় দুপুর এক টার পর তিনি বাসায় মধ্যাহ্ন আহারে যান। ফেরেন এক দের ঘণ্টা পরে। একদিন বড়কর্তার এই বিরতি সময়ে দুই গ্রুপের দুই প্রতিনিধি প্রবেশ করলো তার রুমে।তার কম্পিউটারের ওয়েব ব্রাউজারে প্রবেশ করে তারা ব্রাউজিং হিস্টরি চেক করে দেখলো যে এই  ব্রাউজার থেকে কোন কোন ওয়েব সাইটে প্রবেশ করা হয়। ফলাফল, ব্রাউজিং হিস্টরিতে প্রচুর পর্ণ ওয়েবসাইটে প্রবেশের রেকর্ড। পরীক্ষা করে দেখা গেলো এই সাইটগুলোতে প্রবেশের যে সময়ের রেকর্ড রয়েছে সেই  সময়গুলোতে বড়কর্তা তার অফিস কক্ষেই অবস্থান করেন।বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই প্রমাণ হল যে বড়কর্তা অফিস চলাকালীন সময়ে বদ্ধ কক্ষে বসে পর্ণ সাইট দেখেন।ঐ দিন হয়তো মনের ভুলে সাইটটি খোলা অবস্থায় রেখে চলে গেছেন।  কিন্তু আইটি জ্ঞানের অভাবে তিনি জানেনই না যে কোন  ব্রাউজার দিয়ে কোন সাইটে প্রবেশ করলে ঐ সাইটের রেকর্ড ব্রাউজার হিস্টোরিতে থেকে যায়। তাই রেকর্ডগুলো মোছেননি।তাই এই অজ্ঞতাই সত্য উদঘাটনের নিয়ামক হিসেবে কাজে লেগেছিল।তা নাহলে একটি ভুল সন্দেহ সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা পেতো। 


আমরা অনেক সময় মানুষের জীবনযাপন,ধর্মীয় বিশ্বাস, চালচলন, পোশাক আসাক,আচার ব্যবহার, সামাজিক অবস্থান দেখে নিজের মধ্যে কারো নৈতিক চরিত্রের একটি ধারণা তৈরি করি করি।বাহ্যিক অবয়ক ও অবস্থান দেখে কারো সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা বা বিশ্বাস স্থাপন করি তা অধিকাংশই ক্ষেত্রেই ভুল। যা উল্লেখিত একটি বাস্তব গল্পের মধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হল। যার চালচলন সন্দেহের উদ্বেগ ঘটিয়েছিল সে সত্যিকার্থে ধারণার নোংরা মানুষ নয়।অথচ যাকে অফিসের সবাই সাধু হিসেবে গ্রহণ করেছিল সে যে এমন নোংরা মনের অধিকারী একজন মানুষ তা কেইবা জানতো ।এই সত্য উদঘাটন না হলে সবার কাছে সাধু হিসেবেই অবস্থান করতো। এমন গোপন ঘাতক চরিত্রের অধিকারী বসের অধীনস্থ একজন মহিলা কর্মী কতটা নিরাপদ তা একটু গভীর ভাবে অনুধাবন করলেই বোঝা যায়।অথচ এই মানুষটাই সরকারের যে ধরণের কর্মকর্তা ছিলেন এমন কর্মকর্তারাই কখনো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এমন সাধুর সুরতে হাজারো নোংরা মনে মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে  আমাদের দেশের অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রত্যন্ত জায়গায়।যাদের দ্বারা অনেক নারী নিভৃতে নির্যাতনের স্বীকার হয় যা আমরা জানিনা। জামালপুর জেলার সাবেক ডিসি আহমেদ কবির কর্তৃক অধনস্থ নারী কর্মীর সাথে অনৈতিক কর্মকাণ্ড, এছাড়া ফেনী জেলার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কর্তৃক ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়ন এবং পরবর্তীতে প্রতিবাদ করায় তাকে আগুনে পুড়িয়ে নির্মম ভাবে হত্যা ঘটনা যেন তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। 


মার্জিত পোশাক উন্নত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ আর শৃঙ্খলিত জীবন যাপনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। সমাজের নানা ধর্মীয় বিশ্বাস, অবিশ্বাস,রুচি পছন্দ,পেশা ও সংস্কৃতিগত কারণে একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসরত মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ  ও জীবন যাপনের মধ্যে বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়, এই বৈচিত্র্যতাই যেন একটি রাষ্ট্রের সৌন্দর্য।এই প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের জীবনযাপন প্রণালীর প্রতি একে ওপরের শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টি ভঙ্গি একটি সহনশীল সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওপরদিকে প্রতিটি বৈচিত্র্যময় মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারের রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে নিরপেক্ষ। 


আমি যে দেশটিতে থাকি, এখানে নারী পুরুষের যৌনতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিশেষ কোন বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়। দুইজন মানুষের সম্মতি বা ইচ্ছাই যৌনতার আইনগত অনুমোদন দেয়।তবে ১৫ বছরের নিচে কোন শিশুর সঙ্গে প্রাপ্ত বয়স্ক কোন মানুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপন অপরাধ । কিন্তু ১৫ বছরের নিচে দুজন মানুষের সম্মতি যৌন সম্পর্ক বৈধ।সেই যৌন সম্পর্ক একজোড়া নারী পুরুষ বিবাহ করে করবে অথবা বিবাহ বহির্ভূত ভাবে করবে তা একান্তই তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা। যৌনতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিয়ম কানুনের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক নেই।পাপ পূর্ণ, বিশ্বাস অবিশ্বাস একান্তই ব্যক্তির।রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে  রাষ্ট্র অনুমোদিত প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আইন বিরুদ্ধ প্রতিটি কর্মের বিচার সুনিশ্চিতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থা ধরে রাখা।এখানে যৌন স্বাধীনতা আছে কিন্তু বর্বরতা নেই।ধর্ষণ বা যৌন অপরাধ সংক্রান্ত আইনের কঠোর প্রয়োগ বিদ্যমান থাকায় ধর্ষণের মত সামাজিক অপরাধ বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মত নয়।রাস্তায় বা গণপরিবহণে যৌন হয়রানির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে অপরাধ বিবেচনায় যৌন নিপীড়ককে ৯০ থেকে ৭৫০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।হয়রানির স্বীকার কোন মহিলা জরুরী পুলিশ সেবা নম্বরে কল করলে যৌন নিপীড়কে তাৎক্ষণিক এই শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।আইন আদালত পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে বড় শাস্তি পুলিশের রেকর্ড বইতে এই অপরাধ লিপিবদ্ধ হওয়ায়  ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় অনেক নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে  বাধার সম্মুখী হওয়ার ঝুঁকি অপরাধীর মাথার উপর ঝুলতে থাকে। যা এই দেশের প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে কারাগারের বন্দী দশার চেয়ে বেশি ভয়ংকর।আমাদের দেশে কোন নাগরিকের  কোন প্রশাসনিক প্রয়োজনে চারিত্রিক সনদের প্রয়োজন হলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের কাছে যেতে হয়।সমাজের সর্বোচ্চ খারাপ মানুষ বা অপরাধীও যদি এই সব প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয় তবে দায়িত্বশীল চেয়ারম্যান বা মেয়র চোখ বন্ধ করে ঐ খারাপ মানুষকে উত্তম চরিত্রের সনদপত্র দিয়ে দেয়।ফলে সমাজের সর্বোচ্চ অপরাধীর রাষ্ট্রীয় কোন সুযোগ সুবিধা পেতে বাধা পেতে হয় না।সুতরাং সমাজের ভালো ও খারাপ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের বিশেষ কোন পার্থক্যের দৃষ্টি নেই।যার দরুন আমাদের দেশে একজন সন্ত্রাসী, ঋণ খেলাপি,দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী,ধর্ষণকারীর মত খারাপ মানুষেরা রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি হয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি চোখ রাঙায় পারে।ফরাসি দেশেও  প্রশাসনিক নানাবিধ প্রয়োজনে একজন নাগরিকের চারিত্রিক সনদের প্রয়োজন হয়,যেমন ব্যাংক ঋণ নেয়া, নির্বাচনে প্রতিনিধি হওয়া,নাগরিকত্বের আবেদন করা সহ বহুবিধ প্রয়োজনে এই সনদের প্রয়োজন হয়। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ সনদটি স্থানীয় প্রশাসনের কোন সংস্থা প্রদান করে না, প্রদান করে এখানকার পুলিশ প্রশাসন। কারণ একজন মানুষের দৃশ্যমান বা ধরাপড়া অপরাধ ও অপকর্মের রেকর্ড পুলিশের নথিতে লিপিবদ্ধ থাকে। তাই একজন নাগরিক যখন এমন সনদের জন্য পুলিশ প্রশাসনের নিকট আবেদন করে তখন ঐ নাগরিকের ব্যক্তিগত রেকর্ড পর্যবেক্ষণ এবং নির্দিষ্ট আইন অনুসরণের মাধ্যমে আবেদনকারীকে চারিত্রিক সনদপত্র সরবরাহ করা হয়। যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী তারা বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রতিটি ভালো  মন্দ কর্মের হিসাব লিপিবদ্ধ করেন দুই কাঁধে অবস্থান নেয়া কেরামিন ও কাতেবিন নামে দুই ফেরেশতা। তাদের এই রেকর্ডকৃত কর্মের উপর ভিত্তি করে হাশরের ময়দানের বিচারে দিনে নির্ধারণ হবে একজন মানুষের বেহেশত ও দোযখ।ধর্ম বিশ্বাসের মতই ফরাসি দেশের একজন নাগরিকের রাষ্ট্র নির্দেশিত ভালো ও মন্দ কর্ম রেকর্ডের দায়িত্বে থাকেন পুলিশ প্রশাসন।প্রতিটি নাগরিকের নাগরিকত্ব নম্বর পুলিশ প্রশাসনের সার্ভারের প্রবেশ করে সার্চ দিলেই কম্পিউটার মনিটরে ভেসে ওঠে ফরাসি বৃত্তের একজন মানুষের ন্যায় অন্যায়ের খতিয়ান।সেই খতিয়ান অনুযায়ী ফলাফলও ভোগ করতে হয় প্রত্যেকের। ধর্ম বর্ণ, শ্রেণী পেশার ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযত প্রয়োগের কারণে সামাজিক অপরাধের হার এখানে নিম্নমুখী।এজন্য এখানে একজন নারীকে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,অফিস বা কর্মস্থলে যৌন হয়রানির মত বর্বরতার ভয়ে থাকতে হয়না।কোন মেয়ে যদি অর্ধনগ্ন হয়ে মধ্য রাত্রে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ায় তাহলে তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে কেউ তাকাবে না, কেউ তাকালে বা খারাপ ইচ্ছে পোষণ করলেও আইনের ভয়ে তাকে স্পর্শ করবেনা।  পৃথিবীর নানা জাতিগোষ্ঠী,ধর্ম, বর্ণের মানুষের বসবাস এই ভূখণ্ডে।প্রত্যেকের জীবন যাপন অভ্যাস অনুযায়ী পোশাকের স্বাধীনতা রয়েছে,এখানে অনেক নারীই একটু খোলামেলা পোষাকের  জীবন যাপনে অভ্যস্ত তাই বলে তার প্রদর্শিত শরীর দেখে পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত দেখা মেলে না। শিক্ষিত ও সুসভ্য জাতির মানুষ নিজের স্বাধীনতাকে উপভোগের ব্যাপারে যেমন সচেতন তেমনি অন্যের স্বাধীনতার প্রতিও  শ্রদ্ধাশীল হয়। যা ফরাসি দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন যাপন ও আচার আচরণে প্রতি মুহূর্তে ফুটে ওঠে।বনের হিংস্র বাঘ বা সিংহের শাবককে যদি একটি মানব পরিবারে আদর যত্নে বড় করে তোলা যায় তাহলে  দেখা যাবে বড় হওয়া পর ঐ পূর্ণাঙ্গ বাঘ বা সিংহের মধ্যে সহজাত হিংস্রতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং হিংস্রতার পরিবর্তে মানুষের সঙ্গে বসবাস করারা দরুন উল্টো মানবিক আচরণ করছে। একটি সুসভ্য জাতি বিনির্মাণের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে শ্রেণীর ঊর্ধ্বে গিয়ে আইনের যথার্থ প্রয়োগ।একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছ হয় তাহলে ঐ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আইন ও বিচারের ভয়ে এবং কোন এক সময় নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ায় দরুন  অন্যায় করা ভুলে যায়।এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সুসভ্য সমাজ।


ব্যক্তিগত ভাবে একবার আমার ফরাসি জেলখানা দেখার সুযোগ হয়েছিল।এক পরিচিত ছোট ভাই কোন এক কারণে ফরাসি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানায় প্রেরিত হয়।একদিন প্রোগ্রাম করে এখানকার কয়েকজন বন্ধু মিলে  তাকে দেখতে জেলখানায় যাই। জেলখানার প্রবেশমুখে আমাদের মত অন্যান্য  কারাবাসী স্বজনদের ভির।অনেকগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কঠোর সতর্কতার মধ্যদিয়ে আমরা জেলখানায় প্রবেশ করলাম।একজন পুলিশ আমাদের সঙ্গে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট রুমে বসতে দিলো। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমাদের ঐ ভাইটিকে নিয়ে আসা হল কথা বলার জন্য।আমরা জানতে চাইলাম,সে কেমন আছে সে? পুলিশ কোন খারাপ আচরণ করছে কিনা?কয়েদ খানায় তার সঙ্গে কারা আছে? ইত্যাদি। তাকে কিভাবে মুক্ত করা যায় সে ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করে আমরা চলে এসেছিলাম।ঐ দিন ঐ ভাইয়ের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণের আলোচনায় তার বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে এখানকার জেলখানা সম্পর্কে দারুণ কিছু তথ্য জানতে পেরেছিলাম।


সে জানিয়েছিল, ফরাসি জেলখানায় তার দিন কাটছিল একজন অতিথির মতই। কয়েদিদের সঙ্গে কোন অমানবিক আচরণ হয় কিনা, তা পর্যবেক্ষণের জন্য জেলখানার মধ্যেই মানবধিকার সংস্থার কর্মী রয়েছে যারা কয়েদিদের পর্যবেক্ষণ করেন, তাই ভেতরে ভয়ের কোন কারণ ছিলনা। তার অন্যান্য কয়েদি বন্ধুদের সবাই ভিনদেশি,অর্থাৎ আলজেরিয়া,মরক্কো,তিউনিসিয়া,পাকিস্থান এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের জনগণ।তার কয়েদী বন্ধুদের কেউ ফরাসি বংশোদ্ভূত নয়।কয়েদিরা বাইরে যে যাই করুক কিন্তু ভেতরে সবাই বন্ধুর মত ছিল। 


আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম ফরাসি জেলখানায় ফরাসি আসামী নেই জেনে। কারণ আমি তখন এই দেশে নতুন। এই দেশের মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে বাস্তব ধারণে ছিলনা। তবে আজ বুঝি ফরাসি জেলখানায় কেন ফরাসি বংশোদ্ভূত কয়েদি খুঁজে পাওয়া যায়না।প্রায় দশ বছরের ফরাসি ভূখণ্ডের জীবন যাপন থেকে এই দেশের সমাজ ও সমাজের মানুষ সম্পর্কে কিছু বাস্তব সত্য আবিষ্কার করেছি।তাহলো  অধিকাংশ ফরাসিদের মধ্যে মিথ্যে বলার প্রবণতা নেই, অন্যকে ঠকানোর প্রবণতা নেই, অন্যের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণের প্রবণতা নেই,ওজনে কম দেবার প্রবণতা নেই,খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা নেই,অন্যের সঙ্গে ছল-চাতুরীর প্রবণতা নেই,অর্থ  ও ক্ষমতা বড়াই করে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের প্রবণতা নেই, আর ধর্ষণের মত এমন বর্বরর আচরণ হয়তো চিন্তাই করতে পারে না। একটা সমাজের মানুষের এমন চারিত্রিক গুনের অধিকারী হওয়ার জন্য অনেক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে।ফরাসিরা বই পড়া জাতি। আমরা বলতে পারি পড়াশুনার ভেতর দিয়ে তারা এমন নৈতিক গুনের অধিকারী হয়েছে। এ কথার অবশ্যই যৌক্তিকতা রয়েছে, কারণ জ্ঞান চর্চার ভেতর দিয়ে মানুষ মহামহিম গুনের অধিকারী হয়।এ কথা ধ্রুব সত্য।ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খ্রিস্টান হলেও বৃহৎ অংশ ধর্মীয় রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতা পালন না করে না।আবার অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।অনেক বিখ্যাত ক্যাথলিক গির্জায় ধার্মিকদের চেয়ে পর্যটকদের ভীর বেশী লক্ষ্য করা যায়।তবুও এদেশে সুসভ্য সমাজ বিদ্যমান। আমি মনে করি মানুষ মূলত সুসভ্য হয় একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্য দিয়ে। যা ফরাসি দেশে বিদ্যমান। এই দেশের মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। যা তারা ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে।এখন এই তিনটি শব্দের মধ্যে ফরাসি নাগরিকের জীবনের যে স্বাদ অন্তর্নিহিত রয়েছে তা দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে আরম্ভ করে তৃনমূলের একজন মানুষ পর্যন্ত সমান ভাবে উপভোগ করে। যা সম্ভব হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে।রাষ্ট্রের আইনের বেড়াজালে সবাই একই ভাবে আবদ্ধ।ফলে কেউ ক্ষমতাবান হলেও ক্ষমতার অপব্যবহারের দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা দেখায় না পরিণতির ভয়ে।দীর্ঘদিনের এমন নিয়ন্ত্রিত শাসন কাঠামোর মধ্যে বসবাস করতে করতে ফরাসি জনগোষ্ঠীর মানুষের চিন্তা চেতনা ও ধ্যান ধারণায়  সততা এবং মানবতা জাগ্রত হয়েছে, ফলে সহজাত ভাবে ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা ন্যায় সঙ্গত আচরণ প্রকাশ পায়। সারা পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এই ভূখণ্ডে।অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষকে বাদ দিয়ে যদি  দেশটির প্রতিচ্ছবি কল্পনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে এই দেশটির পুলিশ প্রশাসন ও আইন আদালত বিভাগের খুব একটা প্রয়োজন পড়ছে না, এই বিভাগগুলোর কাজ তিনভাগ কমে গেছে।     


ফ্রান্সে উদার ও রক্ষণশীল সমাজের মাঝে  উগ্র জীবন যাপনও রয়েছে তবে কারো দ্বারা কারো স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা নেই। 


যৌনতা প্রতিটি সমাজে বিদ্যমান। যে সমাজ যৌনতার স্বাধীনতা দেয় সেই সমাজে যৌনতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়ে ওঠে।যৌন স্বাধীনতা বলতে যতেচ্ছ যৌনাচার বোঝায় না।মনে হতে পারে এমন সমাজের মানুষ পশুপাখির মত যেখানে সেখানে যৌন সঙ্গম করে বেড়ায়।বস্তুত এমন চিন্তার সঙ্গে বাস্তবতার বিন্দু পরিমাণ কোন মিল নেই।ফ্রান্সে দীর্ঘ দিনের বসবাসের অভিজ্ঞতায় এমন চিত্র কখনো আমার চোখে ধরা পড়েনি।রক্ষণশীল সমাজে যেমন দুইজন মানুষ ভালবেসে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে,কারো প্রয়োজন হলে পতিতালয়ে গিয়ে যৌনতা কেনে।প্রেমিক প্রেমিকা পার্কের নির্জন ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে চুপিসারে অভিসার করে। এখনেও তেমন। পার্থক্য শুধু এতোটুকু এমন রাষ্ট্রে একজোড়া মানুষ বিবাহ বহির্ভূত ভাবে দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারে।এমন দাম্পত্যের ফলে কোন শিশুর পৃথিবীতে আগমন ঘটলে সেই শিশু রাষ্ট্রের অন্যান্য শিশুর মত সামাজিক ভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার লাভ করে।কোন পার্থক্য করা হয় না।


 যে সমাজ যৌন স্বাধীনতায় রক্ষণশীল সে সমাজে যৌনতা আড়ালে হয় ফলে রক্ষণশীলতার পর্দায় ঢেকে থাকার কারণে বাস্তব চিত্র দেখা যায়না।অর্থাৎ এমন সমাজে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অনুমোদন না থাকায় এমন সম্পর্কগুলো অতি আড়ালে সম্পাদিত হওয়ার প্রধান কারণ।ফলে এমন সমাজ বা রাষ্ট্রে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কারণে কোন শিশুর আগমন ঘটলে সেই শিশুর স্থান হয় ডাস্টবিনে। কারণ রক্ষণশীল রাষ্ট্র ও সমাজ এমন শিশুর সম অধিকার নিয়ে সামাজিক ভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার সংরক্ষণ করে না।  


কোন সমাজ ভালো, কোন সমাজ মন্দ, কোন সমাজ ব্যবস্থা আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করা উচিত সেই পরামর্শ বা বিচারের দায়িত্বে উপরোক্ত কথাগুলো উল্লেখ করিনি। একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে ঐ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের জীবনাচার,কৃষ্টি কালচার,রীতিনীতির উপর ভর করে। তাই কোন প্রথা ভালো, কোন প্রথা মন্দ তা নির্ধারণ করবে ঐ সমাজ বা রাষ্ট্রের মানুষ।এতো বড় পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের বসবাস।বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সামাজিক রীতিনীতি,সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এক একটা সমাজ ও রাষ্ট্র স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে বিভক্ত।  

কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য আমাদের সমাজে কোন নারী ধর্ষিত হলে ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক,আধুনিক জীবন যাপন,ধর্মীয় বিধিবিধান বহির্ভূত জীবন যাপন ইত্যাদি বিষয়কে সামনে এনে  আমরা ধর্ষণকে পরিত্রাণ দেবার চেষ্টায় মেতে উঠি।যা বাস্তবতার সঙ্গে এমন অভিযোগের বড় রকমের কোন সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায়না। 


ধর্মীয় নীতি আদর্শ ও বিধিবিধান অনেক ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার মানে এই নয় রাষ্ট্র ও সমাজের সকল সমস্যার সমাধান এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে,  শুধু বিশেষ আদর্শ অনুসরণ করলেই সুন্দর ও শান্তির সমাজ বিনির্মাণ করা যাবে। 


এমন যদি হতো তবে ইসলাম ধর্মের পুণ্যভূমি সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশী নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন  নির্যাতনের স্বীকার হয়ে দেশে ফিরত না।যেখানে প্রতি ওয়াক্ত নামাজে মধ্যে তাদের মাতৃভাষায় ধর্মীয় আদর্শ,ন্যায়,নীতি ও মানুষে মানুষের সমতা ও মানবতার বানী শোনানো হয়।  

এমন যদি হতো, তাহলে ভারতের ধর্মগুরু রাম রহিম কর্তৃক পূজারীদের ধর্ষণের গোপন যৌন রাজত্ব গড়ে উঠত না। 

ভারতের কেরালায় রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিশপ কর্তৃক নান ধর্ষণের স্বীকার হয়ে বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামতে হতোনা।

দেশের বোরকা পরা পর্দাশীল নারীরা ধর্ষিত হতোনা।

প্রতিদিন সংবাদ পত্রের পাতায় দাঁড়ি,টুপী, জোব্বা পরা দরবেশ সুরতের মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক শিশু ছাত্র বলৎকারের সংবাদ শুনে আশ্চর্য হতে হতো না। 

তাই যদি হতো, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের নারীরা স্বল্প বসনের পোশাক পরার দরুন প্রতিদিন ধর্ষণের স্বীকার হয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতো। 


একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলতার জন্য কি প্রথা বা নিয়মনীতিকে বৈধতা দিতে হবে তা ঐ সমাজের মানুষের জীবনাচারকে  প্রাধান্য দিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করবে। তাদের গবেষণালব্ধ তত্ত্বকে বিচার বিবেচনা করে রাজনীতিবিদরা আইন বানাবে এবং প্রশাসন সেই আইন নিরপেক্ষ ভাবে প্রয়োগ করবে। এটাই প্রক্রিয়া। 


একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি বিশৃঙ্খলার মূল কারণ থাকে অর্থনৈতিক বৈষম্য।যে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য যত বেশী সেই রাষ্ট্রে অপরাধের হার ততো বেশী।এর প্রধান কারণ একটি রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্য গড়ে ওঠে  দীর্ঘদিনের বিরাজমান অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা সূত্রপাত হয় যখন রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি আইন, শাসন বিচার বিভাগ ভেঙ্গে পড়তে থাকে।এই তিনটি স্তর যখন  রোগাক্রান্ত হয়ে যায় তখন ঐ রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের দুর্ভোগের কোন সীমা থাকে না। যে দুর্ভোগের ক্রান্তিকালের মধ্যে কাটছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন। তাই, শুধু ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আইন করে এই সমস্যার সমাধান মিলবে বলে যারা আশা করে যারা বসে আছেন তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। যদিনা রাষ্ট্রের রোগাক্রান্ত আইন,শাসন ও বিচার বিভাগকে পরিপূর্ণ ভাবে আরোগ্য লাভ করানো না যায় তবে ধারাবাহিক গুম,খুন,দুর্নীতি,ঘুষের মতই ধর্ষণের মত বীভৎসতা থেকে রেহাই মিলবেনা।এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।   


সূত্রঃ 

১। সৌদিতে গণধর্ষণের শিকার বাংলাদেশি তরুণী


২। ২০০০ নারীকে ধর্ষণ করেছেন রাম রহিম! 


৩। ভারতে খ্রিস্টান বিশপের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে আন্দোলন করছেন সন্ন্যাসিনীরা


৪। তিনি একজন ‘মানবিক’ বলাৎকারকারী