১০ আগস্ট সবার ঘুম থেকে উঠতে প্রায় দশটা বেজে গেলো। পরিশ্রান্ত শরীর তার প্রাপ্যটুকু ঠিক মতই বুঝে নিয়েছে।সকালের আলস্য ভাবের সাথে নাস্তা করতে করতেই বেলা মধ্যগগনে গিয়ে পৌঁছুলো। ভাবলাম তাহলে মধ্যাহ্ন ভোজের পর্বটা বাসায় সেরে গেলেই উত্তম।দুপুর দেরটার দিকে আমরা ধীরে সুস্থে বাসা থেকে বের হলাম।সুন্দর আলো ঝলমলে দিন,সূর্য মাথার উপর তির্যকভাবে অবস্থান নিয়েছে। নন্ত শহরে আমাদের প্রধান আকর্ষণ Grand éléphant অর্থাৎ বড় হাতি পরিদর্শন।এটি des machine de l’il এর একটি পার্ট। ইন্টারনেটে নন্ত শহর সম্পর্কে জানতে গিয়ে এই হাতির ছবি দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। তাই তেরত ট্রাম স্টেশনে গিয়ে এক তরুণকে মুঠোফোনে হাতির ছবিটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই স্থানে কিভাবে যাবো। ছেলেটি বলল, আপনাদের (Chantiers navals) ছন্তিয়ের নাভেল ট্রাম স্টেশনে নেমে সেতু দিয়ে নদী পার হতে হবে। সেতু পার হলেই Parc des Chantiers। এখানেই বড় হাতিটি রয়েছে। এখানকার ট্রাম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নাম tan তান। ফ্রান্সের প্রতিটি শহরেই স্থানীয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার কিছু ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম ও সুযোগ সুবিধা রয়েছে।আমরা যখন তেরত ট্রাম স্টেশনের অটোমেশিনে টিকেট কাটতে গেলাম তখন স্থানীয় এক অপেক্ষমান যাত্রী আমাদেরকে এখানকার ট্রাম ও বাস টিকেটের কিছু নিয়ম কানুন ও সুবিধার কথা বুঝিয়ে বললেন।তিনি বললেন, প্রতিবার শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য আলাদা আলাদা টিকেট কাটলে বেশী খরচ পড়বে কিন্তু একবারে দশ ইউরো দিয়ে যদি একটা টিকেট কাটা হয় তবে এই এক টিকেটে চার জন যাত্রী চব্বিশ ঘণ্টা ইচ্ছে মত শহরের মধ্যে দিয়ে বাস ও ট্রামে ঘুরতে পারবে।ভেবে দেখলাম,আমরা তিনজন যদি শুধু তিনটি আলাদা টিকেট কেটে শহরে যাই তাতেই প্রায় ছয় ইউরো চলে যাবে,আবার আসার সময় ও শহরে ঘোরাঘুরির সময় টিকেট কাটতে হবে, সবমিলিয়ে শুধু আজকেই টিকেট বাবদ অনেক ইউরো চলে যাবে। সব চিন্তা করে অপশনটা আমাদের জন্য খুবই সাশ্রয়ী ভেবে গ্রহণ করলাম।আমরা তেরত থেকে ট্রামে করে চলে এলাম ছন্তিয়ের নাভেল।এখানে নেমে আমাদের যাওয়ার পরিকল্পনা দে মাসিন দে লিল অর্থাৎ বড় হাতি পরিদর্শন করতে, কিন্তু স্টেশন থেকে একটু দূরে কিছু মানুষের ভিড় দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম।স্থানটিতে পর্যটকেরা ভিড় করে আছে। এটি নন্ত শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা প্রমত্ত লোয়ার নদীর একটি খেয়া ঘাট। নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য খেয়ার প্রতীক্ষায় স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকেরা সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।খেয়া ঘাটে কিছুক্ষণ পর মাঝারী আকারের একটি জাহাজ নোঙ্গর করলো।ইচ্ছে হল,এই খেয়া জাহাজে করে নদীর ওপারে যাওয়ার।ঘাটের টিকেট কাউন্টার অফিসের পাশে একটি পোস্টারে খেয়া পারাপারের মূল্য ও টীকা আকারে কিছু নিয়ম লেখা রয়েছে। নিয়মগুলো পড়ে মনে হল আমরা চব্বিশ ঘণ্টা মেয়াদের বাস ও ট্রামের জন্য যে টিকেট কেটেছি সেই টিকেট দিয়েই খেয়া পার হতে পারবো। তবুও টিকেট কাউণ্টারে বসা দায়িত্বরত এক তরুণীকে আমাদের টিকেটটি প্রদর্শন করে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি এই টিকেট দিয়ে খেয়া পার হতে পারবো, নাকি আলাদা টিকেট কাটতে হবে? তরুণী আমাদের টিকেটটি একটি মেশিনে পরীক্ষা করে বলল, খেয়া পারের জন্য আপনাদের আলাদা টিকেট কাটতে হবে না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই টিকেট দিয়ে আপনারা ইচ্ছে মত খেয়া জাহাজ, বাস ও ট্রাম ব্যবহার করতে পারবেন।খুব ভালো লাগলো শুনে আমাদের আলাদা টিকেট কেটে খেয়া পার হতে হবে না। খেয়া ঘাটের এই টিকেট অফিসটি নন্ত শহরের স্থানীয় পর্যটন সেবা কেন্দ্রও।বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকদের এই শহরের পর্যটন স্থানগুলোর নানাবিধ তথ্যও দেয়া হচ্ছে এখান থেকে।এছাড়া, ফ্রেঞ্চ,ইংরেজি, স্প্যানিশ, চাইনিজ ভাষা সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পর্যটন তথ্য সম্বলিত ছাপানো বই রয়েছে এখানে।পর্যটকেরা প্রয়োজনীয় ভাষার তথ্যবই তথ্য সেবা প্রদানকারী কর্মীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিচ্ছে। বইগুলো বিনা মূল্যে সরবারহ করছে।আমরা, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষার দুটি বই সংগ্রহ করে খেয়া জাহাজের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়ালাম।প্রবাস জীবন প্রায় দশ বছরের।নিজের জন্মস্থান রাজবাড়ী ছেড়ে ঢাকায় বসবাস ছিল ছয় বছর।জীবনের ষোল বছর চলছে নগর বাস।আমার বেড়ে ওঠা মফস্বল শহরে হলেও কাদামাটির স্পর্শ রয়েছে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে।একজন গ্রাম্য বালকের মতই গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নিয়েছি পরিপূর্ণভাবে। নন্ত শহরের লোয়ার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে, অনেক বছর পর আমি আমার বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মার সুতো নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে খেয়া নৌকার অপেক্ষা করছি।লোয়ার নদীটি খুব বেশী প্রশস্ত নয়, এবং আশ্চর্যের বিষয় এই নদীর জল ঘোলা, আমাদের পদ্মা নদীর জলের মত। অনেকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম।চোখে ভেসে উঠছিল সেই ছেলেবেলার সুতো নদীর অনেক ছবি।আমাদের বাড়ী থেকে ১০ মিনিটের পথ হাঁটলেই পদ্মা নদীর তীর।এখন মূল পদ্মা নদী প্রবাহিত শহরের কোল ঘেঁষে, কিন্তু একসময় মূল পদ্মা নদীর তীরে যেতে হলে শাখা নদী পার হয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো।শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো পদ্মার সুতো নদী বা শাখা নদী। প্রমত্ত পদ্মার বিশালতার কাছে এই শাখা নদীটি সুতোর মতই ছিল।বড় পদ্মার নদীর শরীর থেকে ছোট্ট একটি অঙ্গ বেরিয়ে রাজবাড়ীর কালীতলা হয়ে মিশে গিয়েছিল গোয়ালন্দের মূল পদ্মা নদীর সঙ্গে। মূল পদ্মা আর এই সুতো নদীর দূরত্বের মাঝে ছিল বিশাল চর অঞ্চল।এই চরে ছিল হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা ও বসতী।চড় সিলিমপুর, আম্বাড়ীয়া চর আরও কিছু নাম ছিল এই চরের মধ্যকার বিভিন্ন গ্রামের। আমার জীবনে নদীর সাথে পরিচয় ও নদীর স্মৃতি বলতে এই পদ্মার সুতোনদীকেই ঘিরে।বিশাল প্রমত্ত মূল পদ্মার প্রথম দর্শনের স্মৃতি মনে নেই, তবে কৈশোরে পা দিয়ে কৌতূহল বসত বন্ধুদের সাথে কোন শুকনো মৌসুমে সুতো নদী পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে ওপারের ফসলী মাঠ, পাড়া গাঁ মাড়িয়ে একদিন ধু ধু পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে পদ্মার বিশালতার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো আমার।
ছেলেবেলায় পদ্মার এই শাখা নদীটিই ছিল আমার গণ্ডী জীবনের কল্পনায় সবচেয়ে বড় নদী।ভরা মৌসুমে এই নদী ভয়ংকর রূপ ধারণ করতো।বিশাল ঢেউ আঁচড়ে পড়ত নদীর দুই পাড়ে। ঢেউয়ের প্রবল আঘাতে কখনো পাড় ভেঙে পড়ত। নদীর এপারে রাজবাড়ী শহর, ওপারে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। এপারে নদীর পাড় দিয়ে কোথায় ফসলী মাঠ,কোথাও ঘন দেবদারু ও গাব গাছের জংলা প্রকৃতি।।দুই পাড়ের মানুষের একমাত্র সংযোগ মাধ্যম ছিল বৈঠাচালিত খেয়া নৌকা। চর অঞ্চলের মানুষের প্রধান উপজীব্য ছিল কৃষিকাজ, পশুপালন এবং মৎস্যশিকার। মেছোঘাটা, গোদার বাজার ঘাট ছিল একসময়ের ব্যস্ততম নৌবন্দর। এই ঘাটগুলো থেকে নৌপথে পরিবাহিত হতো দূরবর্তী পণ্য ও যাত্রী।আমার দুরন্ত ছেলেবেলা থেকে যৌবনের সোনালি সময়ের সাথে পদ্মার এই সুতোনদীটির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ।
কৈশোরে বন্ধুরা দল বেধে নদীর পাড় ধরে অনেক দূরে চলে যেতাম,পড়ে একসাথে নদীতে ঝাপ দিয়ে সবাই সাঁতার কাটতে কাটতে চলে আসতাম ঘাটে। আবার নিজের সাহসিকতা পরীক্ষার জন্য অনেকবার সাঁতার কেটে নদীর ওপার গিয়ে আবার একাই ফিরে এসেছি এপারে। ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুপসাঁতার কাটতে কাটতে চোখ লাল হয়ে যেতো। কখনো দল বেধে নদীর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সাঁতার কেটে চলে যেতাম নদী ওপারে। নদীর ধারে কৃষকের ক্ষেতে লেগে পড়তাম ক্ষীরা অথবা বাংগি তুলতে। যখন দেখতাম ক্ষেতের কৃষক তেড়ে আসছে আমাদের দিকে অমনি আবার নদীতে ঝাপ দিতাম, সাঁতার কেটে চলে আসতাম এপারে।
বড়শী দিয়ে মাছ ধরা ও ঘুরি ওড়ানোর নেশায় কখনো স্কুল ফাঁকি দিয়ে দিন চলে গেছে নদীর পাড়েই। নদীর পাড় দিয়ে পরিশ্রমী গুণটানা মাঝীর গুণ টেনে হেঁটে চলা ,নদীর বুকে পালতোলা নৌকা থেকে ভেসে আসা গানের সুর স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল।এই নদীতেই এক সময় জেলেদের রূপোলী ইলিশ ধরার ধুম লেগে যেতো। পাঙ্গাশ, বোয়াল সহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় মাছের অবাধ বিচরণ ছিল এই নদীর ঘোলা জলে। সুতো নদীর প্রশস্ততা বেশী না থাকলেও ছিল সুগভীর। মাঝে মাঝে ভারী জাহাজ পার হতো এই ছোট্ট নদীর বুক দিয়ে। কখনো যাত্রা পথে ঘাটে নোঙ্গর করতো। খবর শুনে কৌতূহল ভরে নদীতে যেতাম কাছ থেকে জাহাজ দেখতে। প্রতি বছর এই নদীতে নৌকা বাইচ খেলার আয়োজন হতো,প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য দূর দূরান্ত থেকে দীর্ঘকার বাইচের নৌকায় আসতো।নৌকাগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল,লালন শাহ, শাহ জালাল ইত্যাদি। সাধারণত বিভিন্ন পীর আওলীয়া, মুনি ঋষিদের নাম অনুসরণ করে এইসব প্রতিযোগিতার নৌকাগুলোর নাম রাখা হতো।প্রতিযোগিতা উপলক্ষে নৌকাগুলোকে বিশেষ সাজে সাজানো হতো। নৌকার মাল্লারাও পরত বিশেষ রঙ ও ডিজাইনের পোশাক। নৌকার সামনে ধূপ জ্বালিয়ে মন্ত্র জপতে গেরুয়া পোশাকে বসতেন সাধক, পেছনে বিশাল আকৃতির বৈঠা ধরে দাঁড়াতেন মাঝি, মাঝে মাল্লার দল ছোট ছোট বৈঠায় পানিতে ছন্দ তুলে ছলাত ছলাত শব্দে করে নদীর বক্ষ চিরে এগিয়ে যেতো শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার জন্য।মাল্লাদের সমবেত সুরে গাওয়া বাইচের জারি গানে মুগ্ধ হতো নদীর দুই ধারে অবস্থান নেয়া হাজার হাজার দর্শনার্থী।এখনো সেই সময়ের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলে শরীরে শিহরণ জাগে।
প্রায় প্রতি বছর নদীর উপচে পরা পানিতে বন্যা হতো,নদীর ওপারের চরাঞ্চলে বন্যার পানির সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠত আঊশ, আমন ধান।পানি নেমে গেলে মাঠে নরম পলি মাটির প্রলেপ পরত। কোন কর্ষণ ছাড়াই নরম পলি মাটির কাদায় কৃষক ছিটিয়ে দিতো মাসকলাই ডালের বীজ।কোন সার ছাড়ায় নতুন মাটির উর্বর শক্তিতে সবুজ হয়ে উঠত নদীর ধারের কৃষি ক্ষেত। কোথাও কোথাও মাঠ জুড়ে আউশ, আমন ধানের নাড়ার বিছানা পাতা থাকতো,এর মধ্যে ফুটে থাকতো আকাশী নীলের কলমি ফুল। খেয়া নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে ওপারের আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে যখন বেড়াতে যেতাম তখন প্রকৃতির এমন অকৃত্রিম রূপে বিমোহিত হতাম।
এপারে শৌখিন মৎস্য শিকারিদের সাড়ি সাড়ি বাঁশের মাচা আর নদীর ওপারের শরতে ফোটা কাশফুল, এখনো আমার স্মৃতিতে ছবির মত।
এক সময় পানি কমতে কমতে নদীর বুকটা হয়ে যেতো মরুভূমির বালুকা বেলার মত। মনে হতো নদীর দুই ধারে পাহাড়ের মত সুউচ্চ শক্ত এঁটেল মাটির পাড় আর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শুকনো বালুর মহাসড়ক। এর মধ্যে ছোট্ট বড় কুম ( জমে থাকা গভীর পানির স্থল) পড়ত। নদীতে নতুন পানি না আসা পর্যন্ত এই কুমের মধ্যে চলতো এলাকার মানুষ ও গরু ছাগলের গোছল এবং কাপড় চোপড় ধৌতের কাজ। ছোটবেলায় অনেকবার দাদীর সঙ্গে নদীর কুমে গোছল করতে এসে সাঁতার না জানায় গহীন জলে ডুবে জল খেয়েছি, কেউ না কেউ দেখে আমাকে উদ্ধার করেছে।ছেলেবেলায় আমার সাঁতার শেখা হয়েছে কুমের জলে ডুবে ডুবেই। দাদীর সঙ্গে নদীতে গোছল করতে গেলে সাবানের পরিবর্তে নদীর পাড়ের এঁটেল মাটি দিয়ে চুল পরিষ্কার করে দিতো। শহরতলিতে বসবাস করলেও দারুণ এক গ্রামীণ জীবনের স্বাদ ছিল এই সুতো নদীকে কেন্দ্র করে।
ছেলেবেলায় দেখা বন্ধুদের এক নৃশংস শখের কথা স্মরণ হলে এখনও দারুণ ভাবে অনুতপ্ত হই।দেয়ালের মত নদীর দুই পাড়ের ভাজে ভাজে শত শত গভীর গর্ত থাকতো, সেই গর্তের মধ্যে সংসার পাতত মাছরাঙা পাখীর দল। আমাদের লোভ থাকতো পাখীর বাচ্চার প্রতি।কিন্তু সুগভীর গর্তের মধ্য থেকে হাত ঢুকিয়ে পাখীর বাচ্চা বের করে আনা ছিল দুরূহ কাজ।তাই লম্বা লাঠির সঙ্গে বেতের সীসা পেঁচিয়ে লাঠিটি ঢুকিয়ে দেয়া হতো গর্তের মধ্যে।কখনো লাঠির সঙ্গে বেতের সীসার কাটায় পেঁচিয়ে গর্তের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতো রক্তাক্ত পাখির ছানা।কাজটি ভীষণ অন্যায় ছিল, যা ওই সময়ে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই করতে দেখেছি। ঐ সময়ে আমাদের মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয়নি যে ছোট্ট পাখীর ছানার কাটার আঘাতে দুঃসহ কষ্ট হতো। মা ছাড়া পাখীর ছানাগুলো বাড়ীতে এনে অতি আদর যত্নে পোষার চেষ্টা করলেও কয়েক দিন পর অধিকাংশই মারা যেতো। ছেলেবেলার দুরন্তপনা বা কৌতূহল বশত এগুলো করা হলেও, আজ বুঝি এমন শখ ছিল বড় রকমের অপরাধ। প্রতিটি প্রাণী তার নিজস্ব জীবন যাপনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার চিন্তা ও বুদ্ধির প্রয়োগ এবং যত্ন করে তার বাচ্চা লালন পালন করে বড় করে তোলে ,তার মানসিক বিকাশ ঘটায়।একটি মানব সন্তানকে যেমন বনের পশুকে দিয়ে লালন পালন করা সম্ভব নয়, তেমনি ছোট্ট পাখীর ছানাকে মা ছাড়া করে যতই আদর যত্ন করে বড় করে তোলার চেষ্টা করা হোক না কেন, কখনোই ঐ মা পাখীটির মত করে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে ছোট্ট ছানাটির পাখীত্বের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। প্রতিটি প্রাণীই স্ব স্ব গোত্রেই নিজেদের মত স্বাধীন ও নিরাপদ।প্রাণী জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা মানুষেরই দায়িত্ব। এই বোধ এখন জাগলেও তখন ছিলাম বোধহীন।পাটকাঠির মাথায় জিগার আঠা জড়িয়ে গাং ফড়িং শিকার করে কত চৈতালি দুপুর কেটেছে এই নদীর পাড়ে তার হিসেব নেই।সেটাও ছিল ঐ সময়ের বোধহীন শখ।ফড়িংগুলো ধরার পর যখন আবার ছেড়ে দিতাম তখন ওরা ভালোভাবে উড়তে পারতো না। কারণ পাখায় লেগে থাকা জিকার আঠার ভারে ফড়িংয়ের স্বচ্ছ পাতলা ডানা দুর্বল হয়ে যেতো।
উদিত যৌবনে সুতোনদী আমাকে দিয়েছে অনেক সোনালী মুহূর্ত।প্রতিটি বর্ষাকাল মানে নদীর নব যৌবন।নদীর বুকে ঢেউয়ের খেলা, পাড় ছুঁই ছুঁই পানি। স্কুল,কলেজের ক্লাস শেষ করে প্রতিটি বিকেল রুটিন করে কাটত এই নদীর পাড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই দূর করে দিতো পড়ন্ত বিকেলের নদীর পাড়। নদীর পাড় ধরে কোথাও বসত বাড়ী,আবার কোথাও বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত, সেই ক্ষেতে খোলা বাতাসে চলে কচি সবুজ ধান গাছের ঢেউ খেলানো নৃত্য, সঙ্গে বয়ে চলা নদীর ঘোলা জল তোলে কল কল ধ্বনি।এমনি এক নৈসর্গিক প্রকৃতির মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে কেটেছে অসংখ্য বিকেল। এই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভালোলাগা ভালোবাসার আবেগ অনুভূতিতে আপ্লূত হয়েছি অনেক বার। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের নিচে বসে পানিতে পা ভিজিয়ে নদীর বয়ে চলার দৃশ্য দেখা আমার জীবনের এক অম্লান স্মৃতি।
এতক্ষণ যে ছোট্ট নদীর এতো কথা মনে আঙিনায় ভেসে উঠলো, সেই নদীটি এখন কালের আবর্তে বিলীন। এখন শুধুই স্মৃতি। নদীর এপার ওপারের মানুষের সহজ যোগাযোগের মাধ্যম একটি সেতুর দাবী ছিল দুই পাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের। বিগত বিএনপি সরকারের শাসন আমলের শেষের দিকে স্থানীয় প্রশাসন নিলো এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত, সেতু স্থাপন না করে বরং শুষ্ক মৌসুমে নদীর মাঝে বাঁধ নির্মাণ করে নদীটিকে বেধে দিলো। হত্যা করা হল একটি জীবন্ত যৌবনা নদীকে। তাদের কাছে এই নদীটি অতিরিক্ত অসহ্য মনে হয়েছিল।লোক মুখে কথিত, তৎকালীন স্থানীয় ক্ষমতাসীনরা হয়তো পরিকল্পনা করেছিল প্রমত্ত এই ছোট্ট নদীটিকে দীর্ঘ একটি দীঘিতে রূপান্তর করে মাছ চাষ করবে।এতে স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থান হবে।দুই পাড় এক হয়ে গেলে ওপারের মানুষকে কেউ আর চরের মানুষ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে না।এই বাঁধের কারণে দুই পাড়ের মানুষ এক হয়ে শহুরে মানুষ হয়ে যাবে। এই জেলায় রইবে শুধুমাত্র একটি নদী, তা হল জেলাশহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৃহৎ মূল পদ্মা নদী। আজও মানুষের মনে সন্দেহ, বস্তুত কি পরিকল্পনায় এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো,এই সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের গবেষণা ছিল কিনা? কারণ পদ্মার এই সুতোনদীটির বুকে বাঁধ নির্মাণের পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে মূল পদ্মার ভাঙন শুরু হয়,আগ্রাসী ভাঙন! সেই ভাঙনে নদী গর্ভে বিলীন হয় শতশত ঘরবাড়ী,স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা,ফসলি মাঠ।সেই ভাঙ্গনের ধারাবাহিকতায় কয়েক বছরের মধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় চর সিলিমপুর, আম্বারিয়ার চরের মত বৃহত্তর গ্রাম। হাজার হাজার মানুষের জীবনে নেমে আসে দুঃসহ অন্ধকারের ভবিষ্যৎ। জমি ও বসত বাড়ী হারিয়ে চর অঞ্চলের এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাস্তুহারা হয়ে পেশাগত সঙ্কটে পড়ে। বাধ্য হয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠী জেলা সদর ও এর আশে পাশের অনেক কৃষি জমি কিনে বসতি স্থাপন করে। অনেকেই স্থান নিয়েছে বেড়িবাঁধ,রাস্তার ধারে, কেউবা অন্যের জমিতে এখনও আশ্রিত। যার ফলে রাজবাড়ী জেলা সদর পরিণত হয় একটি ঘনবসতি অঞ্চলে। শহর হারিয়েছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য, ওপারের বংশপরম্পরায় কৃষক, জেলে, নৌকা শ্রমিক হারিয়েছে জীবনের ছন্দ। তাদের কেউ এখন জেলা শহরে রিক্সা চালিয়ে,কেউ রাজমিস্ত্রি’র কাজ করে জীবন চালায়। অনেকেই বাধ্য হয়ে জীবীকার তাগিদে ঢাকার নগর জীবন বেঁছে নিয়েছে। দুচোখে স্বপ্ন, নদীর বুকে আবার কবে জেগে উঠবে চর, আবার ঘর তুলবে পুরনো স্মৃতিবিজড়িত বাস্তুভিটায়।
এখন মূল পদ্মা নদী রাজবাড়ী জেলা শহরের কোল ঘেঁষে প্রবাহিত। প্রতি বছর নদীর ভরা মৌসুমে পদ্মার তর্জন গর্জনে তটস্থ হয়ে ওঠে শহরবাসীর জীবন। ভয়,এবার রাজবাড়ী শহর কি টিকতে পারবে পদ্মার আগ্রাসী আক্রমণকে প্রতিহত করে। শহর বাঁচাতে প্রতি বছর পদ্মার তীর চলে সরকারের শত শত কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ। এখন পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চোখে পড়ে আদিগন্ত জলরাশি।কল্পনায় ভেসে ওঠে এই পানির বুকে একসময়ের জেগে থাকা গ্রাম,মানুষের কোলাহল আর আমার ছেলেবেলার সুতোনদী।
ওই সময়ের ক্ষমতাসীন কোন এক গোয়ার,স্বার্থপর ও লোভী মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে পরিবর্তন হয়ে গেছে একটি জেলার মানচিত্র।পরিবর্তন হয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা। আমাদের দুর্ভাগা দেশের ঘাড়ে চেপে বসা লোভ লালসার নেতৃত্বের কারণে এমন অনেক ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্ত সমগ্র জাতিকেই সর্বনাশা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ছেলেবেলার দুরন্তপনায় অনেক বার সাঁতার কেটে সুতো নদী পাড়ি দিয়েছি, সেই অভিজ্ঞতায় লোয়ার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল চাইলে এই ভিনদেশি নদীটিও সাঁতার কেটে পাড়ি দেয়ার সক্ষমতা এখনো আমার রয়েছে।অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পর ওপার থেকে খেয়াযাত্রী বহন করে খেয়াতরী জাহাজ এসে ঘাটে ভিড়ল।ওপারের খেয়াযাত্রীরা জাহাজ খালি করা মাত্র আমাদের অপেক্ষমাণ যাত্রীরা লাইন ধরে জাহাজে উঠতে লাগলো,নির্দিষ্ট যাত্রী সংখ্যা পূর্ণ হওয়ার পর জাহাজের নাবিক অনন্যা যাত্রীদের পরবর্তী খেয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রেখে জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিলো। ভাগ্য ভালো লাইনের সামনে থাকায় আমাদেরকে পরবর্তী খেয়ার অপেক্ষমাণ লাইনে আর দাঁড়াতে হল না। আমাদের তরি মাঝ নদী দিয়ে ওপারের দিকে এগুতে লাগলো।নদীর মাঝখান থেকে তরিতে বসে শহরের অবয়ব ভিন্নরকম দেখায়।নদীর দুই পাড় দিয়ে গড়ে উঠছে শহরের মানুষের বসবাসের ভবন বাড়ি, অফিস,কমার্শিয়াল সেন্টার,বিনোদন কেন্দ্র। সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলো এই ছোট্ট শহরকে এক শৈল্পিক রূপ দিয়েছে।মাঝ নদী থেকে অবলোকন করলে সেই রূপ ধরা দেয়। মনে হল, এই নদী নন্ত শহরের দুই পাড়ের মানুষকে একটুও ব্যাবচ্ছেদ করেনি বরং দিয়েছে সৌন্দর্য,অটুট মেলোবন্ধন। খেয়া তরি থেকে দুই দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইটি সেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর বুকে।
দশ মিনিটের খেয়া যাত্রা শেষ করে আমরা চলে এলাম নদীর এপার।একটু গ্রাম্য আবহ খুঁজে পাওয়া গেলো।ঘাটের সঙ্গে রেস্তোরাঁর তেরাজে বসে নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুজব করে খাওয়া দাওয়া করছে লোকজন। নদীর পাড়ের সাড়ি সাড়ি পুরনো সেঞ্চুরি গাছের পাশ দিয়ে চলে গেছে পিচ ঢালা সরু রাস্তা।শান বাধানো নদীর কিনার দিয়ে পুরনো ডিজাইনের লোহার রেলিং।আমরা গন্তব্যহীন এই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এগুতে লাগলাম।কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম একটা জংলা প্রকৃতি। গাছপালায় ঘেরা, নদীর কিনার দিয়ে জলজ উদ্ভিদ ইচ্ছে মত বেড়ে উঠেছে।মনে হচ্ছে, আমাদের গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন নদীর ধারে চলে এসেছি।এই প্রকৃতির মধ্যে লাল রঙয়ের সুউচ্চ টিনের তৈরি একটি স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাছে কোন পুরনো আমলের নিদর্শন। কোন এক সময়ের কোন উৎপাদনশীল কারখানার একটি ইউনিট মনে হল।স্থাপনাটির এক পাশে সুবিশাল একটি ঘড়ির পেন্ডুলাম প্রতিনিয়ত এদিক ওদিক করে দুলে যাচ্ছে। ভালো লাগছিলো পেন্ডুলামের এই দুলে চলা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম দুলেচলা পেন্ডুলামের দিকে। মনে হল, জীবনটাও এই পেন্ডুলামের মতই।ঘড়ির পেন্ডুলাম যেমন দুলতে দুলতে একদিন থেমে যায়, মানুষের জীবনটাও এই দোলাচলের মধ্যদিয়ে একদিন চিরস্থায়ী ভাবে থেমে যায়।নশ্বর পৃথিবীর মাঝে আমাদের নশ্বর জীবন।কিন্তু এই ধ্রুব সত্য আমরা জীবদ্দশায় খুব একটা গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পারিনা। এমন সুন্দরের মাঝে মিশেল বেশ বেয়াড়া হয়ে উঠলো। ইচ্ছে মত ছোপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে আর আমাদের চিন্তা বাড়াচ্ছে। আশংকা নতুন জায়গা যদি একটা অঘটন ঘটে।বেশ বিরক্ত হয়ে ওকে রেখেই আমরা ওখান থেকে চলে এলাম,ভাবলাম ভয়ে আমাদের পিছু পিছু চলে আসবে। অনেক দূর আসার পর পেছন ফিরে তাকিয়ে মিশেলের দেখা মিলল না। আমি আবার জংলার দিকে ছুটে গেলাম,একটু খোঁজাখুঁজির পর দেখি সে টিনের স্থাপনার একপাশে নদীর দিক মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। জোর করে ওকে নিয়ে এলাম ওখান থেকে।
সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভাবে নন্ত প্রাক্তন ডিউক শাসিত অঞ্চল এবং এটি এক সময় ব্রিটানি প্রদেশের অংশ ছিল।
নন্ত পে দ্য লা লোয়ার রেজিওঁর প্রধান প্রশাসনিক শহর।
আমরা প্লাস রয়্যালে এবার বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।প্রায় প্রতিটি মূর্তি খুব কাছ থেকে দেখলাম,ভালোলাগা ভাস্কর্য ধরে ছবি তুললাম। ছোট আকারের প্রাণীর ভাস্করের পিঠে চড়ে মিশেল নিজের মত আনন্দ করতে লাগলো।কখনো এই শত শত ভাস্কর্যের রাজ্যে নিজের মত দৌড়াদৌড়ি করে আমাদের থেকে কয়েকবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
প্লাস রয়্যালের পাশে আকাশমুখী সুউচ্চ মিনার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাঝারি আকৃতির খ্রিস্ট ধর্মীয় উপাসনালয়।এখানে ছোট আকৃতির গির্জাকে ইগ্লিস, বড় আকৃতির গির্জাকে বলে ক্যাথেড্রাল।এটি একটি ক্যাথেড্রাল।কোন বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল না হলেও এর স্থাপত্য শৈলী বেশ আকর্ষণীয়।মধ্যযুগীয় ও আধুনিক নক্সায় তৈরি একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন।প্লাস রয়্যাল থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু সুন্দর সময় কাটল এখানে।
দিনের এতোটুকু ঘোরাঘুরিতে ইতোমধ্যে এই অচেনা শহরটা আমাদের অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে।পথঘাট ও অলিগলি ঘুরপ্যাঁচ অনেকটাই বুঝে ফেলেছি।আমরা বিকেল ছয়টার দিকে প্লাস রয়্যাল এলাকা থেকে বেরিয়ে এবার হাঁটতে হাঁটতে লোয়ার নদীর সেতু উপর দিয়ে চলে এলাম (des machine de l’il) দে মাসিন দো লিল এলাকায় অর্থাৎ আমাদের কাঙ্ক্ষিত বড় হাতির কাছে।নদীর এপারে শহরের মানুষের ব্যস্ততার ছোটাছুটি নেই।মনে হল,শহরের এপার রাখা হয়েছে মানুষের অবকাশ যাপনের জন্য।ফ্রাসের প্রতিটি শহরেই মধ্যযুগীয় বড় বড় খ্রিস্ট ধর্মীয় গির্জার নিদর্শন মেলে।কিন্তু গির্জাগুলোর আয়তন আকারে উপাসনাকারী ধার্মিকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী গির্জার শাসনের সময় এই উপাসনা কেন্দ্রগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো।বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম যখন বিচ্ছিন্ন হয় তখন থেকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের ক্ষেত্রে ফরাসিদের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে,তাছাড়া ধর্মীয় অনেক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসেও পরিবর্তন শুরু হয়।এখানকার ফরাসি জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশের পারিবারিক ধর্মীয় পরিচয় থাকলেও তারা ধর্ম পালন ও বিশ্বাস করে না।কিন্তু ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তারা সৎ ও মানবিক মানুষ।ফ্রান্সের ঐতিহাসিক খ্রিস্ট ধর্মীয় গির্জাগুলোতে যতটা না উপাসনার জন্য গুরুত্ব পায় তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব পায় পর্যটন স্থান হিসেবে। প্যারিসের স্যাক্রে ক্যোর বাসিলিকা, নতর দামের মত ঐতিহাসিক ক্যাথেড্রালে মধ্যে একদিকে উপাসনা চলে অন্যদিকে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। আমি নিজেও পরিচিতজনদের নিয়ে অনেকবার এই বিখ্যাত গির্জা দুটি পরিদর্শন করেছি। গির্জা বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষদের প্রার্থনা কেন্দ্র হলেও ফ্রান্সের গির্জাগুলোর দরজা খোলা থাকে সকলের জন্য।এখানে কেউ প্রার্থনার জন্য যায় বিশেষ ভক্তি নিয়ে, কেউ যায় দেখতে।আমার কাছে মনে হয়েছে, এদিক থেকে ফ্রান্সের যীশুর অনুসারীরা এক ধর্মীয় উদারতার বিশেষ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রেখেছে। এছাড়া ফ্রান্সে যে সব ক্যাথলিক অর্থায়নের মানবিক সংস্থা রয়েছে সেসব সংস্থাগুলোতে যেসব দুস্থ মানুষ মানবিক সহায়তার জন্য যায় সেখানে ঐসব দুস্থ মানুষদের ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনা করে সেবা প্রদান করা হয় না, বরং ঐসব মানুষের দুর্দশাকে প্রাধান্য দিয়ে সেবা দেয়া হয়, বিনিময়ে আর্তের নিকট কোন কিছু আশা করা হয় না। বিশেষ ধর্মীয় সংস্থা হলেও চাকুরীর ক্ষেত্রেও বিশেষ ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্ব পায়না।অর্থাৎ,হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টান, নাস্তিক সে যে বিশ্বাসের মানুষই হোক না কেন ঐসব প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতে পারে।
অর্থায়নকারী ও সেবা প্রদানকারী ধার্মিক স্রষ্টার সৃষ্টিকে সেবা প্রদানের মধ্যে ধর্মীয় আদর্শের মহত্ত্ব খুঁজে নেন।নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, এ ব্যাপারটিতেও ফ্রান্সের খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা মহানুভবতার দারুণ এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রেখেছে। যেমন, ছেকর ক্যাথলিক ইউরোপের বৃহত্তর ধর্মীয় মানবিক সংস্থা হলেও সংস্থাটি পরিচালনা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ ধর্মীয় রীতি নীতির ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায় না। মানবিক কাজে শুধুই মানবিকতাকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে ......