শুক্রবার, ১ মে, ২০২০

বলছি বাংলাদেশের পরিপাটি পোশাক পরা মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীদের বৈষম্যের কথা।

সাধারণ ভাবে আমরা জানি,যিনি শ্রম দেন তিনি শ্রমিক, যিনি শ্রমের বিনিময়ে নির্দিষ্ট অর্থ উপার্জন করেন তিনিই শ্রমিক।শ্রম দুই ধরণের ১ কায়িক শ্রম ২ মানসিক শ্রম।


১৮৮৬ সালে পহেলা মে  আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।এই সমাবেশ রুখে দিতে  তৎকালীন সরকারের  মদদে শ্রমিকদের উপর গুলী চালায় পুলিশ।এতে নিহত হয় ১১ জন শ্রমিক। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হওয়া শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয়জনকে প্রহসন মূলক বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।যাদের আত্মত্যাগের কারণে আজ প্রতিষ্ঠিত কলকারখানা ও অফিস আদালতের আট ঘণ্টার শ্রমঘণ্টা। প্রতি বছর পহেলা মে আমরা ঐসব আত্মত্যাগী মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকি।এই দিবসে সাধারণত কায়িক পরিশ্রম করা  শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলি। কিন্তু যারা বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে মানসিক শ্রম দেন সেই সব স্যুট কোর্ট পরা কর্মীদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা আমরা কখনো ভাবি কি?  

বাংলাদেশের (২০০৬-২০১৩) শ্রম আইনে যারা ঘণ্টা অনুযায়ী কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জন করেন সেইসব মানুষদের শ্রমজীবীর শ্রেণীর আওতাধীন করে তাদের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।  

কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রশাসনিক ,তদারকি ও ব্যবস্থাপনা সাথে জড়িত কর্মীদের উক্ত শ্রম আইনের সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 

আমরা দেখতে পাই সরকারী অফিস আদালতে যারা কাজ করেন সেখানে পিয়ন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত সকাল নয়টা পাঁচটা অর্থাৎ আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টার সুবিধা ভোগ করে থাকেন এবং দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি।কিন্তু, এর বাইরের ক্ষেত্র অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীরা কি এই সুবিধা ভোগ করে থাকেন? কি আইনে চলে তাদের শ্রম দেয়ার সময় সীমা।তা রাষ্ট্রীয় ভাবে অনেকটাই ঝাপসা।চলে ঐ সব প্রতিষ্ঠানের মনগড়া নিয়ম নীতির উপর। 

এই আলোচনায় যাওয়ার আগে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটু বর্ণনা করে নিলে বুঝতে অনেকটাই সহজ হবে।


২০০৬ সালে বাংলাদেশে একাডেমিক পড়াশুনা সম্পন্ন হওয়ার পর জীবিকার তাগিদে একটি খাদ্য উৎপাদন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে একাউণ্টেণ্ট পদে কাজে যোগদান করি।নিয়োগের সময় নিয়োগ চুক্তি পত্রে আমার কর্মঘণ্টা নির্ধারিত হয় প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সপ্তাহে ছয় দিন, অর্থাৎ দিনে দশ ঘণ্টা করে মাসে দুইশত চল্লিশ ঘণ্টার কাজের চুক্তি।যেহেতু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরী এবং জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে কাজে যোগদান করেছিলাম।বয়সে তরুণ,প্রাণশক্তিতে ভরা জীবন, তাই  প্রথম প্রথম দিনে দশ ঘণ্টা শ্রম তেমন কিছু মনে হতোনা।কিন্তু কাজে যোগদানের পর কখনো সন্ধ্যা সাতটার সময় অফিস থেকে  বের হতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না ।কারণ, আমার সিনিয়ররা সন্ধ্যা সাতটার পর অফিসে বসে থাকতো,তারা অফিসে বসে কাজ করলে আমরা জুনিয়রেরা কিভাবে অফিস থেকে বেড়িয়ে যাই। এই ইতস্ততার কারণে আমরাও কাজ করতাম,   আর না থাকলে বসে থাকতাম ওনাদের বেরোনোর অপেক্ষায়।অধিকাংশ দিন অফিস থেকে বের হতে প্রায় রাত আটটা বেজে যেতো।আমাদের মালিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত।তিনি সারা দিন অফিসের বাইরে থাকতেন,সপ্তাহে ন্যূনতম দুই দিন সন্ধ্যা সাতটার পর অফিসে ফোন করে বলতেন আমি রাত আটটার দিকে অফিসে আসছি,জরুরী মিটিং করতে হবে, সবাই যেন অফিস থেকে না বের হয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর চরম বিরক্তি নিয়ে বসের অপেক্ষায় সবাই বসে থাকতাম।তিনি তার দেয়া সময়ের পর ইচ্ছে মত সময়ে অফিসে আসত।কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ,কখনো গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে রাত এগারোটা বাজিয়ে দিতো।উনি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মঘণ্টার মধ্যবর্তী সময়ে মিটিং করতেন না, কারণ তার প্রবণতা ছিল কিভাবে কর্মচারীদের অতিরিক্ত সময় খাটিয়ে লাভবান হবেন। ঢাকার যানজট মাড়িয়ে মধ্যরাতে বাসায় ফিরে কোনোমত খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পরতে হতো পরের দিন সময় মত অফিসে যাওয়ার জন্য।কারণ,প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের নির্দেশ সবাইকে সকাল নয়টার মধ্যে অফিসে এসে কাজ শুরু করতে হবে।তার বানানোর নিয়ম ছিল, মাসে তিনদিন সকাল নয়টার পর যারা অফিসে আসবে তাদের একদিনের বেতন কর্তন করা হবে। সেই দেরী যদি প্রতিদিন পাঁচ মিনিট করে পনেরো মিনিট হয় তবুও একদিনের বেতন কর্তন।আবার ঈদের সময় কারো চাকুরীর বয়স এক বছর পূর্ণ হতে একদিন বাকী থাকলে তার বোনাস হতো না।কারো সাথে কর্ণধারের মনমালিন্য হলে এক মুহূর্তের নোটিশে চাকুরীও চলে যেতো।সরকারের অনেক বড় বড় অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপক হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। দু একজনের ক্ষেত্রে দেখেছি, কাউকে চাকুরীতে রাখবেনা কিন্তু তাকে সরাসরি না বলে বিভিন্ন ওজুহাতে কয়েক মাসের বেতন আটকিয়ে দিতেন।একটা সময় ভদ্র লোকেরা বকেয়া বেতন ছাড়াই নীরবে অফিসে আসা বন্ধ করে দিতো। মালিকের স্ত্রীর গাড়ি চালক ছালামের বেতন হয় আমাদের হিশাব বিভাগ থেকে।একদিন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমাদের রুমে এসে বললেন, ড্রাইভার ছালামের বেতন আটকিয়ে দিতে।সবার বেতন হল কিন্তু ছালামের বেতন হল না।লোকটি বেতন ছাড়া কিছু দিন চাকুরী করে অন্য জায়গায় একটি চাকুরী ঠিক করে আমাদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেলেন।কিন্তু কিছুদিন পর পর ছালাম আমাদের হিশাব বিভাগে এসে জিজ্ঞেস করত স্যার আমার বকেয়া বেতনটা কি হয়েছে? আমাদের যেহেতু মালিকের নির্দেশ নেই তাই খারাপ লাগার শর্তেও বলতে হতো ভাই আপনার বেতনটা এখনো পাশ হয়নি তাই দিতে পারছিনা।এভাবে আসতে আসতে এবং একই কথা শুনতে শুনতে একদিন ড্রাইভার ছালাম আমাদের অফিসের প্রবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনার ভঙ্গীতে হাত তুলে বলল, আল্লাহ আমার পরিশ্রমের টাকা যে মেরে দিলো তার বিচার করো।এই বলে ছালাম চলে গেলো, আর কোনোদিন তাকে আমাদের অফিসে দেখিনি।ছালামের অপরাধ ছিল, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের স্ত্রীর পার্টিতে পরে যাওয়া একটি ড্রেস লন্ড্রিতে দেয়া হয়েছিলো, সেই ড্রেসটি ছালাম সময় মত আনতে ভুলে গিয়েছিলো।       

কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি,প্রমোশন ছিল মালিকের ইচ্ছে অনুযায়ী।এ ক্ষেত্রে প্রথমে অগ্রাধিকার পেতো নিজের আত্মীয় স্বজন,দ্বিতীয় তোষামোদি।শিক্ষা,যোগ্যতা,অভিজ্ঞতা,জ্যেষ্ঠতার বিচার বিবেচনা প্রাধান্য পেতো না কখনো।  

 মালিক অফিসের  নির্ধারিত সময়ের পরও  কখনো ফোন দিয়ে  হিশাব নিকাশ, ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইতো ।বিদেশে অবস্থান করলে মধ্যরাতে তার ফোন আসত অফিস সংক্রান্ত বিষয়ে।তিনি মনে করতেন তার কর্মচারীরা চব্বিশ ঘণ্টার কেনা গোলাম।মনে করতেন না তার মত প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, তিনি শুধু তার কর্মচারির চুক্তিবদ্ধ কর্মঘণ্টা কিনেছেন,দিনের পুরো সময় নয়।


 আমার কাজটিকে মানসিক শ্রমের আওতায় ধরা হলেও শারীরিক শ্রমও কম ছিলোনা।সারাদিন প্রতিষ্ঠানের হিশাব বইতে কলম চালানো, কম্পিউটার মনিটরে তাকিয়ে থেকে সজাগ মস্তিষ্কে কীবোর্ডে নখ চালানো,প্রয়োজনে দিনে কয়েকবার ব্যাংকে যাওয়া আসা, ইত্যাদি করতে করতে ক্লান্তি চলে আসত।মাঝে মাঝে ভুলের কারণে,কখনো অকারণে অশোভন আচরণের সম্মুখীনও হতে হতো।আবার কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজনের কলা কৌশলের প্রয়োগ করাও হতো।যাতে সবাই সম্মিলিত ভাবে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুলতে না পারে। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন অফিসের সবাইকেই পড়তে হতো।মাস শেষে যখন বেতনের সময় আসত, তখন কর্ণধারের আচরণ পাল্টে যেতো।মাসের প্রথমের পরিবর্তে তার চিন্তা থাকতো কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন কতটা দেরী করে দেওয়া যায়।প্রবণতা বেতনের অর্থটা কতটুকু বেশী সময় ব্যবসায় খাটানো যায়।বেতনটা যখন ছেড়ে দিতো তখন বোঝানোর চেষ্টা করত, আপনার চাকুরীটা কত গুরুত্বপূর্ণ,এই চাকুরীর উপর আপনার সংসার চলে, আমার দয়ার কারণে সেই চাকুরীটা টিকে আছে।আমি আপনাদের প্রভু, আপনাদের বেঁচে থাকার ত্রাণকর্তা। কিন্তু, তিনি কখনো অনুধাবন করতেন না যে যারা চাকুরী করছে এইচ আর, ইঞ্জিনিয়ারিং ,একাউণ্টস,মার্কেটিং,লজিস্টিকস,প্রকিউরমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে প্রত্যেক কর্মকর্তা কর্মচারীর স্ব স্ব শ্রম দেবার যোগ্যতা অর্জন করতে জীবনের পঁচিশ বছর কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাতে হয়েছে।সেই সাথে তাদের ত্রিশ দিনের পরিশ্রমের ন্যায্য অধিকার হচ্ছে এই বেতন। যা কিছুতেই প্রতিষ্ঠানের মালিকের দয়া দাক্ষিণ্য নয়।এমন নির্যাতন মেনে নিয়েই সবাই চাকুরী করত কারণ, চাকুরীটা চলে গেলে পরের মাসের বাসা ভাড়া আটকে যাবে, কারো বাচ্চার স্কুলের বেতন দেয়া হবে না,বাজার করার টাকা থাকবে না, গ্রামের বাড়ীতে বাবা মাকে টাকা পাঠানো হবে না, নতুন একটা চাকুরী খুঁজতে অনেকটা সময় লাগবে ইত্যাদি। আমি নিজেও এমন নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কয়কেবার কর্ম ছেড়ে দেবার প্রতিজ্ঞায় অফিসে যাওয়া  বন্ধ করে দিয়েছি, উল্লেখিত অনিশ্চয়তার কথা ভেবে আবার কর্মে ফিরেছি।মূলত, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রের তুলনায় কর্মীর আধিক্য এবং বেসরকারি চাকুরী খাতে রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরা মানুষের বিপদ ও প্রয়োজনকে পূঁজি করে এমন শ্রম শোষণের বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে।  


কথায় আছে শ্রমিকের শ্রম চুরি না করলে কখনো ধনী হওয়া যায়না।আমার প্রতিষ্ঠানের কথাই ধরি,ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় ত্রিশ জন মাসিক বেতনভুক্ত ব্যবস্থাপক ও তদারককারী ছিলেন।যাদের মূলত আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে দিনে আট ঘণ্টা শ্রম দেবার কথা ছিল।অতিরিক্ত সময় বাদ দিয়ে প্রতিদিনের চুক্তিবদ্ধ দশ ঘণ্টা সময় যদি ধরি তাহলে আমার ঐ সময়ের প্রাক্তন মালিক প্রতিদিন ত্রিশ জন কর্মকর্তার কাছ থেকে দিনে ৩০X২=৬০ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৬০x৬=৩৬০ ঘণ্টা, মাসে ৩৬০x ৪=১৪৪০ঘণ্টা,বছরে ১৪৪০x১১=১৫৮৪০ ঘণ্টা (বিভিন্ন ছুটির কারণে বছরকে ১১ মাস ধরা হয়েছে) অতিরিক্ত সময় সরকারের আইনের ফাঁক খুঁজে বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতো।প্রতি বছর এই ১৫৮৪০ ঘণ্টার আর্থিক মূল্য নির্ণয় করলে অনুধাবন করুণ প্রতিষ্ঠানের মালিক কত টাকা কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে লাভবান হয়েছেন। কর্মকর্তাদের এই ত্যাগের মূল্য প্রতিষ্ঠানের মালিক কখন কি নরম হৃদয়ে অনুধাবন করেছেন?বরং তার আচরণে সব সময় দম্ভ প্রকাশ পেতো, আমার চাকুরী করো বলেই তোমাদের জীবন চলে।


আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলাম, এখন হয়তো এমন ঘটনা মিলে যাবে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে কাজ করা অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীর কর্মক্ষেত্রের প্রাত্যহিক জীবনে। 

বাংলাদেশে একমাত্র সরকারী চাকুরী, ব্যাংক,কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্যতিত সঠিক ভাবে আন্তর্জাতিক লেবার আইন মেনে কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় না।বাকী হাজার হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লক্ষ লক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারী আমার উল্লেখিত বর্ণনার মত বঞ্চনা বৈষম্যের স্বীকার হন।কিন্তু এই বিশাল মানসিক শ্রম দেয়া মানুষগুলো দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন, সরকারকে কর দেন। কিন্তু, তাদের চাকুরী করতে হয় প্রতিদিন  চাকুরী হারাবার ভয়ে দাস মনোবৃত্তি নিয়ে।কারণ তারা চাকুরী হারালে তাদের জন্য নেই কোন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইন ও আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা।কিছু থাকলেও কাগজে কলমে যার বাস্তব প্রয়োগ একেবারেই নেই।প্রমাণ, সরকারী আদেশ অমান্য করে চলমান লক ডাউন চলা কালে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করা কর্মীদের কাজে যোগ দেবার  নির্দেশ প্রদানের ঘটনা।এই সরকারী আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানসিক শ্রম দেয়া কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যবহার করা হয় মালিকদের বানানো নিয়ম অনুযায়ী খেলার পুতুলের মত করে।যা দেখার কেউ নাই।এই শ্রেণীর মানুষ চাইলেই পারে না ডেস্ক ফেলে রিক্সার হাতল ধরতে, না পারে চুরি করতে।ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদতে হয় সারা জীবন, কিন্তু চলতে হয় হাসি মুখে। 


আমরা মাঝে মাঝে দেখি বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার সংবাদ কর্মীদের বেতন আটকে যাওয়ার ঘটনা ।বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া বেতনের জন্য রাস্তায় নামতে।একই দেশে সরকারী চাকুরী করা কর্মকর্তা কর্মচারীরা যখন মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে নাকে তৈল দিয়ে ঘুমায়।তখন বেসরকারি খাতের অনেকে কর্মকর্তাদের থাকতে হয় বেতন না পাওয়ার অনিশ্চয়তায়।এই বৈষম্য ঘোচানোর আজ সময় এসেছে।পৃথিবীর অনেক দেশেই কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীদের অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে। যার কঠোর প্রয়োগও রয়েছে।আমি ফ্রান্সে থাকি, এখানে সরকারী এবং বেসরকারি চাকুরীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র প্রবর্তিত শ্রম আইন মেনে শ্রমিক কর্মচারী নিয়োগ করা হয় এবং নিয়োগকর্তাকেও সরকারের শ্রমিক সংক্রান্ত নিয়ম নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে শ্রমিকের শ্রম ব্যবহার করতে হয় ।অন্যথায় কর্মচারীর অভিযোগে নিয়োগকর্তার আদালতের সম্মুখীন হয়ে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হতে পারে।যার দরুন একজন সরকারী কর্মচারী চাকুরী জীবনের শুরু থেকে অবসর কালীন শেষ সময় পর্যন্ত যে সুযোগ সুবিধার আওতায় থাকে,একজন বেসরকারি খাতের কর্মচারীও একই সুবিধা ভোগ করে থাকে।শ্রমিক মালিক এখানে স্বতন্ত্র।চুক্তি অনুযায়ী শ্রমঘণ্টার  পর ব্যক্তিগত ভাবে উভয়ই স্বাধীন,কেউ কারো সাথে কাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে যুক্ত নন। 


সারা পৃথিবী  এখন করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর সম্মুখীন। আর্থিক মন্দার মধ্যে সময় কাটাতে হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।এই দুর্যোগকালীন সময়েও আটকে থাকবেনা সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা। কিন্তু এই মহামারীর দোহাই দিয়ে আটকে গেছে অনেক বেসরকারি খাতের শ্রমিক,কর্মচারী,কর্মকর্তাদের বেতন।অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা বছর এইসব কর্মীদের খাটিয়ে দ্বিগুণ মুনাফা করলেও এখন তাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে, এই দুইমাসের ব্যবসায়ীক মন্দায় তারা রাস্তার ফকির হয়ে গিয়েছে।কর্মচারীর বেতন দেবে কোথা থেকে। দুর্যোগ যে কোনো সময় আসতে পারে, ব্যবসা কখনো ভালো,কখনো মন্দ সময় কাটাতে পারে।সেই বিষয় মাথায় রেখেই বেসরকারি খাতের  কর্মকর্তা  কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষায় বেতন ভাতা সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় বিশেষ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ অতীব জরুরী। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা চেয়ার টেবিলে বসে মানসিক শ্রমের বিনিময়ে ব্যবসায়ের লভ্যাংশ ভোগ করেন না। তারা ব্যবসায়ে অধিক মুনাফা কালীন সময়েও নির্ধারিত বেতন পেয়ে থাকে।অধিক মুনাফার কারণে দ্বিগুণ বেতন পায় না।সুতরাং মন্দা কালীন সময়ে কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা নিয়ে বেসরকারি খাতের টালবাহানাও গ্রহণযোগ্য নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের অনিয়ম ও বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরী। সেই সাথে বৈষম্যের স্বীকার লক্ষ লক্ষ মানসিক শ্রম দেয়া কর্মীদের সোচ্চার আওয়াজ অপরিহার্য। 

আজকের এই মহান মে দিবসে ঐসব নীরবে নিভৃতে বৈষম্যের স্বীকার হওয়া  কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা এবং প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কথা বলার আহ্বান।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন