২৯ মে সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম প্লাসা ম্যাগবা চত্বরে।চাইনিজ একটি প্রতিষ্ঠানের তত্বাবধানে
পূর্ণগতিতে চলছে বৈশাখী মঞ্চ প্রস্তুতের কাজ।বার্সেলোনা বাংলাদেশ সমিতির নেতৃবৃন্দের অনেকের সাথে দেখা এবং একসাথে সকালের নাস্তা হলো একটি বেকারির দোকানে।বৈশাখের এই আয়োজন বৈশাখ মাসে না হলেও এই দিনে বার্সেলোনার প্রকৃতিতে ছিলো পূর্ণ বাংলার বৈশাখের স্বরুপ।সূর্য তেজস্ক্রিয় রূপে আকাশে অবস্থান নিয়েছে,বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে কাল বৈশাখীর গতিবেগে।মাঠে স্থাপিত
ষ্টলগুলো প্রবল বাতাসের তোড়ে একবার উল্টে গেলো।স্বেচ্ছাসেবকের দল বিরক্ত না হয়ে আবার স্টলগুলো পুনস্থাপনের কাজে লেগেগেলেন।কারণ, প্রবাসের বৈশাখী আয়োজনে প্রকৃতির এমন আচরণ যেন এক বাড়তি উপহার।
কাব্য কামরুল দম্পতি ও হাসনাত জাহান আপা রয়েছেন এখানকার দুটি
বাঙ্গালী পরিবারের সঙ্গে।ভেবেছিলাম উনারা হয়তো সকালে এই মেলার স্থলে চলে আসবেন।পরে এক সাথে
ঘুরতে বের হওয়া যাবে।অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম ওনাদের জন্য।উজ্জ্বল
ভাই মেলার মাঠ প্রস্তুতির সহযোগীতায় ব্যস্ত ,সেও ওনাদের
সম্পর্কে কিছু বলতে পারলোনা।হাসনাত আপা মুঠোফোন প্রযুক্তি ব্যবহার করেননা ,আর কাব্য কামরুলের সাথেও যোগাযোগ
করা সম্ভব হলোনা,তাছাড়া কাব্য কামরুল বিকেলে বৈশাখী মঞ্চে পূঁথি
পাঠ করবেন সে জন্য তার প্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে।তাই তাকে
বিরক্ত করা ঠিক হবেনা ভেবে উজ্জ্বল ভাইকে বলে একাই ক্যামেরা হাতে বেড়িয়ে পড়লাম অচেনা
বার্সেলোনার পথে।প্লাসা ম্যাগবা থেকে প্লাস দো কাতালোনিয়া পর্যন্ত আমার আয়ত্বের
মধ্য,তাই প্লাস দো কাতালোনিয়া এসে সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকে যে বড় সরণিগুলো বিভিন্ন
দিকে বেরিয়ে গিয়েছে এর যে কোন একটি সরণি ধরে যত দূর ইচ্ছে হেঁটে শহর দেখতে দেখতে অজানা
একটি স্থানে গিয়ে পৌঁছুবো। একটি সরণির দিকে তাকিয়ে রাস্তার দু ধারের স্থাপনার
শেষ সীমান্তে চোখে ধরা পড়লো অরণ্যে-ঘেরা
সুউচ্চ পাহাড়।এই সরণি ধরে কিছু পথ হাটার পর পাহাড়টির দিকে তাকিয়ে মনে হলো
এর চূড়ায় একটি খ্রীষ্ট ধর্মীয় গীর্জা রয়েছে।গীর্জাটিকে লক্ষ্য করে হাঁটা শুরু করলাম।হাঁটতে হাঁটতে
কোন এক পর্যায়ে অনুমান করে সংক্ষিপ্ত পথ খুজে বের করতে গিয়ে মূল পথটিই হারিয়ে ফেললাম।আর ইচ্ছে
হলোনা লক্ষ্য স্থলের দিকে ছুটতে।তাই এলোমেলো ভাবে হাঁটতে শুরু করলাম।প্রথম দিনের
আগমন ও ঘোরাঘুরির পর বার্সেলোনা সম্পর্কে যে ধারনা তৈরী হয়ছিলো তা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করলো।এলোমেলো হেটে আমি বার্সেলোনার
যে এলাকায় চলে এসেছি সেটি নতুনরূপে পরিকল্পিত ভাবে নগরায়ন করা হয়েছে।বৃক্ষে শোভিত
সড়কগুলোর দু ধার দিয়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর উচ্চতর ভবন।রাস্তার
মাঝে কোথাও কোথাও ছোট আকারের শিশুদের খেলাধুলার পার্ক।এই শহরে
কোন পথচারী যেন সুপেয় পানির কষ্ট না পায় সে কথা ভেবেই যেন শহরের আনাচে কানাচে তৈরী
করে রাখা হয়েছে পানির কল।তবে বার্সেলোনার পানির কলগুলোর একটি বিশেষত্ব রয়েছে,তা হলো
প্রতিটি কলের উপরে বসানো রয়েছে বিশেষ কোন ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য,সাথে তার জীবন বৃত্তান্তের ছোট্ট বিবরণী,আবার
অনেক ভাস্কর্য শুধুই দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম মাত্র।
রৌদ্রজ্জ্বল
দিনে বার্সেলোনার তপ্ত পথে হাঁটতে হাঁটতে একটু
শীতল ছায়ার খোঁজে ঢুকে পড়লাম একটি উঁচু গলির পথ ধরে একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে।কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটি পাহাড়ের সামনে
এসে দাড়িয়ে পড়লাম,পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে মাঝারি বাউন্ডারি ওয়ালের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে সরু রাস্তা।সরু রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটতেই দেখলাম একটি
লোহার গেটের সামনে সাইনবোর্ডে কাতালান ভাষায় লেখা JARDIN DEL TURO DEL PUTGET , বুঝলাম এটি একট পাহাড়ী
বাগান।জনমানবশূন্য বাগানটির প্রবেশ
পথ উন্মুক্ত দেখে কিছুটা ভীতি নিয়েই ডুকে পড়লাম। বৃক্ষরাজী, বুনো ফুল এবং
তৃনলতায় ঢাকা জংলা পাহাড়ের কোল ঘেঁসে বেয়ে উঠে গিয়েছে সরু পিচ ডালা পথ।সেই পথ ধরেই ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকলাম। পাহাড়ী এই বাগানের প্রথম ধাপে তৈরি করে
রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য ছোট আকারের পার্ক,কিছু শিশু কিশোর সেখানে গাছের ছায়ায়
আপন মনে খেলছে।এই বেয়ে চলা রাস্তার পাশে
মাঝে মাঝে কিছুটা সমভূমি বানিয়ে বসার জায়গা তৈরী করে রাখা হয়েছে ,কিছু মানুষ ঝোপ ঝাড়ে ঘেরা এই স্থানগুলোতে বসে নিরবে বই পড়ছে ,গল্পগুজব করছে।অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে আমি পুগে পাহাড়ী বাগানটির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে অভিভূত হলাম।মনে হলো সমস্ত বার্সেলোনা শহর যেন আমার চোখের সামনে।এক দিকে তাকালে মনে হচ্ছে সমতল ভূমির উপর দিয়ে গড়ে ওঠা ইট পাথরের অট্টালিকাগুলো মিশে গিয়েছে ভূমধ্যসাগরের
নীলচে জলের সঙ্গে।।অন্য পাশে পাহাড়ী উচু নিচু
ভূমিতে গড়ে উঠেছে বিশাল আবাসিক এলাকা ,কোথাও কোথাও গভীর কুঁজকাননে ঘেরা পাহাড়ের মধ্যদিয়ে উঁকি দিচ্ছে কিছু দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্যশৈলীর বাড়ীঘর।আমাদের বার্সেলোনা ভ্রমনের অন্যতম আকর্ষন ছাগরেদা ফামিলা পরিদর্শন।কিন্তু পরিদর্শনের আগেই এই পাহাড়চূড়া থেকেই আবিষ্কার করলাম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন এবং বার্সেলোনার অন্যতম পর্যটন আকর্ষন ছাগরেদা ফামিলা,এর কিছুটা দুরত্বে এই শহরের সমস্ত স্থাপনার উচ্চতা ভেদ করে দাড়িয়ে আছে সাগরের নীলচে রঙে অনেকটা ক্ষেপনাস্ত্র সদৃশ তোর আকবার (Torre Agber) ভবনটি।পাহাড়ের উপর স্থাপিত যে গীর্জাটি ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা নিয়ে বার্সেলোনার অচেনা পথে পা বাড়িয়ে এলোমেলো পথ হেঁটে এই পাহাড়ী বাগানের চূড়ায় উঠেছি সেই তেমপল দো ছাগরা(Temple de Sagrat) গীর্জাটিরও দেখা মিললো এখান থেকে।এমন নির্জন নৈসর্গিক পরিবেশের সাক্ষী হবার জন্য নিজের ছবি তোলার ইচ্ছে হলো।বিশাল আকৃতির একটি কুকুর সঙ্গী করে চূড়ার এক পাশে বসে গল্প করছে স্থানীয় দুই কাতালান তরুনী,ওদের কাছে গিয়ে ইংরেজীতে অনুরোধ করলাম আমার কিছু ছবি তুলে দেওয়ার।খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে নয়নাভিরাম বার্সেলোনা শহরকে সাথে রেখে ওরা দুজন মিলে বেশ কিছু ছবি তুলে দিলো।
আরো কিছুক্ষণ JARDIN DEL TURO DEL PUTGET তে অবস্থান করার ইচ্ছে থাকলেও বৈশাখী মেলার কথা চিন্তা করে দ্রুত ত্যাগ করতে হলো এই পাহাড়ী বাগান ।সহজে প্লাসা ম্যাগবা চত্বরে ফিরে যাওয়ার জন্য এবার আশেপাশের একটি মেট্র ষ্ট্রেশন খুজে নিলাম।মেলার চত্বরে পৌঁছে আমাদের সঙ্গীদের সবার সঙ্গে দেখা হলো।বৈশাখী র্যালী ইতোমধ্যে শেষ হয়ে মঞ্চে চলছে স্থানীয় প্রবাসী তরুন শিল্পীদের সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা।প্রবাসী বাঙালী এক অষ্টাদশী তরুণীর সাথে এক জন কাতালান তরুণীর বাংলাদেশী নাচের পোশাক ও সঙ্গীতের সুরে দ্বৈত নৃত্যের পরিবেশনা দেখে বেশ অবাক হলাম।হঠাৎ বৈশাখের রঙয়ে রঙিন হয়ে শাড়ী পড়া এক ঝাক প্রবাসী বাঙ্গালী রমনীর মঞ্চে আগমন ঘটলো বৈশাখী ঝড়ের মতোই,বাদ্য যন্ত্রের তালে সবাই সমস্বরে গাইলেই বৈশাখের গান এবং প্রচলিত জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান।মনে হলো বার্সেলোনা প্রবাসী বাঙ্গালীদের প্রতিভার এক দারুন সমারহ ঘটেছে আজকের এই বৈশাখী মঞ্চে।
নানা ভাবে সাজানো অনুষ্ঠান মালার একটা পর্ব মনটা প্রফুল্লতায় ভরিয়ে দিলো।মঞ্চে প্রায় বিশজন সদস্যের একটি গানের দল,তিন চারজন বাঙ্গালী শিল্পী ব্যতিত সবাই শ্বেদ চামড়ার বিদেশী।এক বাঙ্গালী তরুনী এবং পাভেল নামের এক তরুন শিল্পীর নেতৃত্বে সবাই সমস্বরে গাইছে কবি গুরু রবি ঠাকুরের গান «যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে »।পরিবেশনায় শিল্পীদের স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গী বলে দিচ্ছে সবাই গানের কথাগুলো সাথে পরিচিত এবং পুলকিত।পরে তারা অন্য দেশের অন্য ভাষায় আরো কয়েকটি মনোমুগ্ধকর গান দলীয়ভাবে পরিবেশন করলো। নানা ভাষাভাষীর শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত এই গানের দলটির নাম ‘কোরাল আসিয়া’, এরা মূলত এশিয়ার পঁচিশটি দেশের পঁচিশটি ভাষায় সঙ্গীত চর্চা এবং পরিবেশন করে থাকে।
মেলার স্টলগুলো দেশীয় পিঠাপুলি ও নানা প্রকারের খাবারের সমারহে সাজানো হয়েছে।মঞ্চের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশী বৈচিত্রময় বাঙ্গালী পোষাক পরিহিত প্রবাসী নারী পুরুষ,শিশু কিশোরের দল ভীর জমিয়েছে খাবার স্টলগুলোতে বাঙলার রসনার স্বাদের আশায়।প্রবাসী বাঙালীদের সাথে কিছু স্থানীয় সাদা বর্ণের মানুষেরাও
বৈশাখী পোষাক শাড়ী ও পাঞ্জাবী পরে এই উৎসব আনন্দের অংশ হয়েছে।বার্সেলোনার প্রবাসী বাঙালীদের মনে প্রতি বছরের এই বৈশাখী আয়োজন আনন্দের দিনটা এক বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে, তাই এই দিনে সবাই শতভাগ বাঙালী সাজ পোষাকে নিজেকে রাঙ্গিয়ে নিতে সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন।মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে দেখা মিললো তারই বহিঃপ্রকাশ। আর এই আনন্দ উৎসবের তাৎক্ষণিক চিত্র সরাসরি সম্প্রচার চলছে অনলাইন ভিত্তিক টিভি চ্যানেল পলাশ টিভি’র মাধ্যমে।
সবাই অধীর আগ্রহে রয়েছে অনুষ্ঠানের মূল পর্বের অপেক্ষায়।তাই মেলার আয়োজক নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তৃতা পর্ব দীর্ঘায়িত না করে দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে দিলেন সঙ্গীতের মহাযজ্ঞ সৃষ্টির আশায়।পরিশীলন উপস্থাপনায় পরন্ত বিকেলের আলোয় বার্সেলোনার কয়েকজন পেশাদার প্রবাসী শিল্পীর একক সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যদিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠানের মূল পর্ব।এর পরেই কাব্য কামরুলের গ্রাম বাঙলার ঐতিহ্যবাহী লুপ্তপ্রায় পুঁথি পাঠের সুর উপস্থিত সবাইকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে গেলো সেই ফেলে আসা সুদূর বাংলার মাটির কাছে।নানা রংয়ের জোরাতালির এক বাহারী আলখেল্লা পোষাকের সাজে মঞ্চে আসলেন পবন দাস বাউল।গাইলেন,নাচলেন,সবাইকে সঙ্গীতের ঘোরের মধ্যে রেখে বিদায় নিলেন।নব্বই দশকের তরুনদের অনেকেই প্রতিক্ষায় রয়েছেন তপন চৌধুরী’র বিখ্যাত গানগুলো শোনার।তার গাওয়া ‘পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে এসেছে দারুন মাস’গানটি আমার অত্যন্ত প্রিয়।যখন স্কুলে পড়তাম নব্বই একানব্বই সাল হবে, তখন রাজবাড়ী সরকারী কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কোন একটি ছাত্র সংগঠনের প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসেছিলেন তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এবং ঐ সময়ের তরুণ তরুণীদের কাছে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে থাকা সোলস ব্যান্ডের এই ভোকালিষ্ট।সেই সময় তার গানে মাতাল করেছিলেন রাজবাড়ীর তরুণদেরকে। প্রায় পঁচিশ বছর পর আবার সুযোগ হলো প্রবাসের মঞ্চে এই প্রিয় শিল্পীর স্বকন্ঠে গান শোনার।বয়সে মধ্যাহ্নের সীমানা অতিক্রম করা এই শিল্পী তারুণ্যদীপ্ত ভঙ্গীতেই গাইলেন তার জনপ্রিয় গানগুলো,তার সাথে গাইলেন,নাচলেন বার্সেলোনার সুর সাধনার সুন্দরী রমনীদের দল ।সর্বশেষ মঞ্চে আসলেন নীল রংঙের বাউলিয়ানা পাঞ্জাবী পরে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় বাউল শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন।তিনি শুধু গাইতে আসলেন না,সবাইকে গাওয়াতেও আসলেন।তার দুই একটি গান পরিবেশনের পর আবার অনুরোধ করে তিনি মঞ্চে ফিরিয়ে আনলেন পবন বাউলকে, তার সঙ্গে বাজানোর জন্য।দুই বাউলের সঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় সন্ধ্যের প্লাসা ম্যাগবার বৈশাখী মঞ্চটি লাল নীল আলোর ঝলকানির সাথে এক ভিন্ন মাত্রার সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করলো।এই সুরের মায়াজাল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারলেননা তপন চৌধুরীও।তিনিও যোগ দিলেন। তিন কিংবদন্তি শিল্পীর যৌথ পরিবেশনায় এবার সত্যি মঞ্চে সঙ্গীতের এক মহাযজ্ঞ শুরু হলো।মেলায় আগত প্রবাসী বাঙ্গালী ও কাতালানরা কিছুক্ষণের জন্য বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সঙ্গীতের সুরের সুখে বুঁদ হয়ে এক ভিন্ন জগতে বিচরণ করলেন।স্থানীয় প্রশাসনের ধরাবাধা নিয়ম কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হঠাৎ মঞ্চের আলো নিভে গেলো। ভাঙল স্পেনের বার্সেলোনা প্রবাসী বাঙ্গালীদের সারা বছরের প্রতিক্ষার এই মিলন মেলা।সুখের এক ভিন্নতর আবেশ নিয়ে নীড়ে ফিরলো সবাই পরবর্তী বছরের এমন আরেকটি দিনের অপেক্ষায়।
এত বড় এক আয়োজনের ছোট খাটো অসঙ্গতি বাদে,প্রবাসের বুকে এমন সুন্দর,সুশৃংখল এবং পরিমার্জিত একটি মেলা উপহার দেওয়ার মূল খুঁজতে গিয়ে আমার দুই দিনের অবস্থান থেকে যেটা মনে হয়েছে, তাহলো এখানকার প্রবাসীদের মধ্যে দল মত নির্বিশেষে রয়েছে ঐক্যের মানুসিকতা এবং সৌহার্দ্যের সম্পর্ক।জ্যেষ্ঠ কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের রয়েছে নবাগত প্রবাসী ও তরুনদের প্রতি স্নেহ ও তদারকির দৃষ্টিভঙ্গী, আর কনিষ্ঠদের রয়েছে জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি নেতৃত্ব মানা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মানুসিকতা।তাই এই শহরে প্রায় চার হাজার প্রবাসী বাঙ্গালীর বসবাসে একটি পাড়া মহল্লার মতই সুখে দুঃখে একসাথে মিলেমিশে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।এই বাঙ্গালী মহল্লার মানুষেরা শুধু ব্যবসা বানিজ্য আর কর্মেই মসগুল থাকেন না,তারা শিল্প সংস্কৃতির চর্চাও করেন তারই স্বাক্ষর রাখলেন এই আয়োজনের মাধ্যমে।
অনুষ্ঠানের শেষে শিল্পী, কলাকুশলী ও অতিথিদের নৈশ ভোজের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো জ্যেষ্ঠ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব
আলাউদ্দিন
হকের রেস্তোরায়। খাওয়া দাওয়ার পূর্বে জমে উঠলো শিল্পী,অতিথি ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের মধ্যে শিল্প সংস্কৃতি,জীবন দর্শন নিয়ে দারুন এক আড্ডা।এখানেও পরিবেশন করা হলো স্পেনের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পায়লা’, সাথে যার যার পছন্দের পানীয় সামগ্রী।তবে এবার পায়লা খেতে গিয়ে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হলোনা,পরিচিত খাবারের মতই আবারো নিলাম ঝিনুক,অক্টোপাস ,চিংড়ী আর চালের সংমিশ্রনে তৈরী খিচুরী সদৃশ পায়লার স্বাদ। খাওদা দাওয়ার মধ্যেই বাউল ফকির শাহাবুদ্দিন গাইতে শুরু করলেন ‘জেনেশুনে সাধুর লেবাজ গায়ে মাখিসনা’,এবং এই আড্ডাকে বাউলের বাসা বলে আখ্যা দিয়ে মন প্রান উজার করে গাইতে লাগলেন।কিছুক্ষণের জন্য মধ্যরাতের রেস্তোরা ঘরটি বাউলের আখড়া খানায় পরিণত হলো।পবন দাস বাউল অত্যন্ত দরদ দিয়ে গাইলেন ‘আমি তোমার মত ভক্ত পেলে হৃদ মন্দিরে রাখী,একবার আয় আয়…. ও..দেখিরে… ও..তোমায় নয়ন ভরে দেখি
’।ফকির শাহাবুদ্দিন পবন দাস বাউলকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন প্রদর্শন-পূর্বক গাইলেন ‘আমি তোমায় সেবা করমু দয়াল আমার ঘরে আইলে,বড় লজ্জা পাইবো দয়াল তোমারে না পাইলে’। দুই বিখ্যাত বাউলের এমন একটি আড্ডায় উপস্থিত থাকতে পেরে সত্যি মনটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছিলো।এমন বিরল মুহূর্তগুলোকে তাই ভিডিওতে ধারণ করতে ভুল করলাম না।কিন্তু সময়ের সীমাবদ্ধতার কারনে ভালোলাগার রেশ কাটতেনা কাটতেই ভেঙ্গে গেলো মধ্যরাতের ক্ষণিকের এই বাউলের আখড়াখানা।
৩০
মে বার্সেলোনা থেকে প্যারিসের উদ্দ্যেশ্যে আমার বাস ছাড়বে দুপুর আড়াইটায়।সংক্ষিপ্ত সফরের দুটি দিন স্বপ্নের মতই পার হয়ে গেলো।বার্সেলোনা আগমনে উজ্জ্বল ভাই, নতুন পরিচয় হওয়া কাতালান প্রবাসী বাঙ্গালী বন্ধুদের আদর আপ্যায়ন এবং আতিথেয়তায় মনে হলো অনেকদিন পর যেন কোন নিকট আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে এসে গভীর এক মমত্বের
বন্ধনে আটকা পড়ে আবার সুদূরে চলে যেতে হচ্ছে।
যে মানুষটির আমন্ত্রণে সুন্দর একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হলো সেই কামরুল হাসান উজ্জ্বল ভাই সম্পর্কে একটু না বললে লেখাটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
সমাজতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা ও প্রচন্ড রকমের সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি প্রবাস জীবনের শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিজস্ব চিন্তাধারায় নিজেকে এখনো স্থির রেখেছেন।সপ্তাহে ছয় দিন সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করেও ছুটির দিনে অবসর না কাটিয়ে সাংগঠনিক বা কোননা কোন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে কখনো ক্লান্তিবোধ করেননা।কখনো বড় আয়োজনের সুযোগ না হলে নিজের বাসায়ই বিশ রকমে ভর্তা ভাতের আয়োজন করে সংস্কৃতিমনা বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রবাসের বুকে আয়োজন করে ফেলেন বৈশাখী কিংবা কোন নবান্ন উৎসব ।আবার কখনো প্রবাসী পারিবারিক বন্ধুদের নিয়ে কোন ছুটির দিনে বিশেষ কোনো স্থানে ঘোরার আয়োজন করে সবাইকে তৈরী করে দেন নির্মল আনন্দের ব্যবস্থা।বড় কোন সাংস্কৃতিক আয়োজনে অনুষ্ঠান পরিকল্পনার পাশাপাশী নিজেই হাতেই তুলে নেন মঞ্চ সজ্জার কাজ ,আপন মনে অনুষ্ঠানের বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কখনো পেশাদার শিল্পীর মত শৈল্পীক মঞ্চ তৈরী করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।কারণ রঙ তুলির সাথে তার সখ্যতা সেই ছেলে বেলা থেকেই।কোন শিল্পী ,সাহিত্যিক বা কোন গুনে গুণান্বিত মানুষদের প্রতি রয়েছে তার উদার ভাবে ভালাবাসার একটি অন্তর ,তাই এই দূর প্রবাসের বুকে এমন কোন মানুষের খোঁজ পেলে তিনি মনে করেন মহামূল্য কোন রত্নের সন্ধান পেয়েছেন।এমন মানুষদের সঙ্গে নিজে থেকেই যোগাযোগ স্থাপন করে তাদেরকে সাধ্যমত আদর আপ্যায়ন ও সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেন।এই সুদূর পরবাসে যে মানুষগুলোর চেষ্টা ,ত্যাগ ও পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক সংগঠন ও যাদের আয়োজনে মাঝে মাঝে প্রবাসের দূরত্বের কষ্ট ভুলে গিয়ে প্রবাসি বাঙ্গালীরা মেতে ওঠে দেশজ উৎসব আনন্দে,কামরুল হাসা উজ্জ্বল
সেই সব স্বপ্ন দেখা ত্যাগী মানুষদেরই একজন।
মধুর
কিছু স্মৃতি সঙ্গী করে ৩০মে সকাল নয়টায় হোটেল থেকে বেড়িয়ে
পড়লাম।পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সারে নয়টায় প্লাসা ম্যাগবা ময়দানে কাব্য কামরুল দম্পতি এবং হাসনাত জাহান আপা’র সাথে সাক্ষাৎ হলো।আমাদের আগমন একসাথে হলেও প্যারিসে ফেরাটা
হচ্ছে যার যার মত করে,হাসনাত আপা ৩১মে’র বিমান
টিকেট বুকিং করেছেন আর
কাব্য দম্পতি পুনরায় ফিরবেন যুইবুচ(Ouibus)এ ,ফলে ওনারা ৩০ মে’র সারা দিন বার্সেলোনার
কিছু দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের পরিকল্পনা নিয়ে বেরিয়েছেন, আর আমার বাস দুপুরে ছাড়ার কারনে বাকীটা
সময় ওনাদের সাথে কাটানোর উদ্দেশ্যে আমরা একসাথে ছাগরেদা ফামিলা পরিদর্শনের জন্য প্লাস
দো কাতালোনিয়া থেকে মেট্র ট্রেনে উঠলাম।ছাগরেদা ফামিলা মেট্র ষ্টেশন থেকে উপরে উঠতেই চোখে পড়লো স্থাপত্যেই এই অমর নিদর্শন। আকাশচুম্বী নির্মাণাধীন চারটি মিনার দাড়িয়ে আছে,মিনারের মাঝামাঝি অবস্থানে যীশু’র একটি দন্ডায়মান মূর্তি অনেকটা ঝুলন্তের মত।পর্যটকের দল ঊর্ধমূখী হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে এর বিশালতা।জেনেছি এটি একশত বছর ধরে নির্মাণাধীন খ্রীষ্ট ধর্মীয় গীর্জা।কিন্তু আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছি সেখান থেকে পুরা-নিদর্শনের ছিটে ফোটাও খুঁজে পেলাম না। তাই কাব্য কামরুল কিছুটা সংশয় নিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখতে উদ্যত হলেন।গীর্জাটির অপর পাশে পৌছুতেই সংশয় সত্য হলো।এখানেও দন্ডায়মান চারটি মিনার কিন্তু গীর্জাটির প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু করে মিনারের মাঝামাঝি পর্যন্ত খ্রীষ্ট ধর্মের নানা চরিত্রের ছোট ছোট মূর্তি আকারের প্রতিকৃতিসহ বৈচিত্রময় কারুকার্যেখঁচিত।স্থাপত্যটির রংবিহীন দেহ’ই বলে দিচ্ছে তার বয়স।ভেতরের শিল্পকর্ম দর্শনের জন্য বাইরে পর্যটকদের লাইন।কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য সেই লাইনে সামীল না হয়ে শুধু ছাগরেদা ফামিলা’র বাইরের রূপ দেখেই আমরা বিদায় নিলাম।স্থপতি এন্টনি গাউদির নকশায় নির্মানাধীন এই গীর্জাটি দর্শন করতে প্রতি বছর প্রায় ২.৮ মিলিয়ন দর্শনার্থী এখানে ভীড় করেন।১৮৮২ সালে এই স্থাপত্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় যা এখনো চলমান।২০২৬ সালে এন্টনি গউদির মৃত্যুর একশত বছর পূর্তি হবে।তাই তার মৃত্যুর একশত বছর বিশেষভাবে উদযাপনের জন্য ছাগরেদা ফামিলা ২০২৬ সালে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে চলছে।এখান থেকে আমরা চলে গেলাম এন্টনি গাউদির আর একটি বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন
কাসা বাৎলো (CASA BATILLO)পরিদর্শনের জন্য।কাসা বাৎলো বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা কল্পকাহিনীর সিনেমার বাড়ীর মত।যে কারো হঠাৎ মনে হতে পারে বাড়ীটিতে হয়ত অশরীরী আত্মা অথবা পরীদের বসবাস।
যারা স্থাপত্য নিয়ে কাজ
করেন,এই শিল্পকে ভালোবাসেন,এর উপর পড়াশোনার করেন তাদের কাছে বার্সেলোনা একটি
স্বপ্নের শহর,কারণ এই শহরেই রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি এন্টনি গাউদির
বিখ্যাত ও অনন্য কাজগুলোর অনেক নিদর্শন।কাসা
ভিসেন্স,ফিন্সা
গুয়েল,সাগ্রাডা
ফামিলিয়া,পালাউ
গুয়েল,কোল-লেগি দে লেস তেরেসিয়ানেস,কাসা
কালভেট,মিরালেসের গেট ও বেড়া বিল্ডিং,পার্ক
গুয়েল,কাসা
বাৎলো,কাসা
মিলা,এসকোলেস দে লাঁ সাগার্ডা ফ্যামিলিয়া উল্লেখযোগ্য।এর
মধ্যে থেকে অনেকগুলো কাজ বিভিন্ন সময়ে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব
ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে
স্বীকৃতি লাভ করেছে। যে
স্থপতি এই শহরের সমৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন,যার অবদানকে আজ বার্সেলোনা তথা স্পেনের অর্থনীতির
অন্যতম ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, সেই মানুষটির মৃত্যুর
গল্পটি বেশ বেদনাদায়ক।
প্রাত্যাহিক দিনের
মত ৭ জুন ১৯২৬ সালে ক্যাথলিক ধর্মপ্রাণ গাউদি অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে সেন্ট ফেলিপ
গীর্জার দিকে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে হাঁটছিলেন।জিরোনা
ও বেইলিন স্ট্রিটের মাঝে গ্রান বিয়া দে লেস কোর্তেস কাতালানিস-এর মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় তিনি একটি ধাবমান ট্রামের সাথে ধাক্কা লাগার
ফলে আহত হন এবং চেতনা হারিয়ে ফেলেন।তার পরনের জীর্ণ পোশাক ও পরিচয় সূচক কোন প্রমানপত্র বা কাগজপত্র কাছে না থাকায় তাৎক্ষণিক
চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।এরপর একজন পুলিশ অফিসার ট্যাক্সিতে করে তাঁকে সান্তা
ক্রিউ হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু সেখানে পূর্ণাঙ্গ যত্ন পাননা বরং অবহেলার
স্বীকার হন।দুর্ঘটনার পরেরদিন সাগার্ডা ফামিলার যাজক মোঁসে গিল পারেস তাকে চিনতে পারেন।কিন্তু
এতক্ষণে গাউদির অবস্থা চরম অবনতি ঘটে,উচ্চতর চিকিৎসা দেয়ার অবস্থা আর থাকেনা।১০ই জুন, ১৯২৬ সালে ৭৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।মৃত্যুর দুইদিন পর অবহেলায়
মৃত্যুবরণ করা গাউদিকে মাউন্ট কার্মেলের লেডির চ্যাপেলের সমাধিস্থলে বিশাল মানুষের
সমাগমে শেষ বিদায় জানানো হয়।
কাসা বাৎলো থেকেই বিদায় নিতে হলো আমার তিন ভ্রমণসঙ্গীর কাছ থেকে।তিনদিন একত্র যাপনের পর ওনাদের রেখে একা চলে যাওয়ার সময় একটু বিরহ বেদনা অনুভব করলাম ,যদিও প্যারিসে আবার সবার সাথে নিয়মিতই দেখা হবে।বার্সেলোনা থেকে ফিরছি কিন্তু আমার ছোট্ট মামুনি মিশেলের জন্য কিছু না নিলে কেমন হয় ,তাই আবার ফিরে এলাম রামলায়।সুভেনীরের দোকান ঘুরে কিনলাম ওর প্রিয় কার্টুন চরিত্র কীতি মীমী’র একটি পুতুল আর ওর মামুনী’র জন্য হাত ঘরি।বার্সেলোনার তার্কিস কাবাবে’র স্বাদটা শেষবারের মত নেয়ার জন্য পথের খাবার হিসেবে সঙ্গে নিলাম একটি তার্কিস কাবাবের পুলিন্দা।পরেরো ঘন্টার যাত্রা তাই পানীয় সামগ্রীর মজুদটাও বেশ ভারী করতে হলো।তিন দিনের ঘোরাঘুরিতেই শহরটা বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলো,মনে হচ্ছিলোনা এই শহরে আমি ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এসেছিলাম।
নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ মিনিট পূর্বেই চলে এলাম বাস ষ্ট্যান্ডে।এবারো আমার নির্ধারিত সীটে আরেক তরুণীর অবস্থান ,তবে এবার আসার দিনের মত আর বিশেষ সৌজন্যতা না দেখিয়ে আমার প্রিয় জানালার পাশের আসনটি বিনীত অনুরোধে বুঝে নিলাম। ঠিক আড়াইটাই বাস যাত্রা শুরু করলো প্যারিসের উদ্দেশ্যে।আবার কবে আসার সুযোগ হবে স্থাপত্য ,ফুটবল ও মুক্তিকামী মানুষের
এই নগরীতে,ভেবে বাসের জানালা দিয়ে নগরীর রূপটাকে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম ,আর হুমায়ূন আজাদের বিখ্যাত একটি কবিতা ‘ভালো থেকো’র লাইনগুলোর মতোই মনে মনে বলছিলাম, ভালো থেকে বার্সেলোনা, ভালো থেকো।আসার দিন রাতের অন্ধকার ও ঘুমন্ত অবস্থায়
ফ্রান্সের সীমা পারি দিয়ে স্পেনের ভূমিতে পৌঁছেছিলাম, তাই দেখা হয়নি স্পেনের ভূপ্রকৃতি এবং ফরাসী ভূমির অনেকাংশ।দিনের আলোয় যাত্রা শুরু করায় ফেরার পথে মিললো সেই সুযোগ।অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের সীমানা পারি দিয়ে বাস প্রবেশ করলো বিস্তৃর্ণ পাহাড়ী ভূমির মধ্যদিয়ে বয়ে চলা মহাসড়কে।চারিদিকে উঁচুনিচু পাহাড়ী ভূমির মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে কাতালান জনগোষ্ঠীর বসতি ,এই বৈরী ভূপ্রকৃতির মধ্যেদিয়ে তৈরী করা হয়েছে যোগাযোগের রাস্তাঘাট।কোথাও কোথাও এই ভূমিকে তৈরী করা হয়েছে কৃষি কাজের উপযুক্ত করে,ফলান হয়েছে নানা প্রজাতির ফসল।তবে স্পেনের ভূপ্রকৃতি আমার কাছে মনে হয়েছে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত এবং প্রকৃতি যেন আপন মনে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে।অনেক এলাকা জনমানবের বসতিবিহীন কঠিন পাথর আবৃত পাহাড়ী ভূমিতে শিকড় আঁকড়ে দাড়িয়ে আছে বুনো বৃক্ষরাজির দল।মাঝে মাঝে মনে ইচ্ছে জাগছিলো
যদি বাস থেকে নেমে এই বুনো প্রকৃতি দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে পারতাম।কিন্তু ইচ্ছে থাকলেইতো দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা যুইবুচ(ouibus)কখনোই আমার ইচ্ছে পূরণ করতে ক্ষণিকের জন্য থেমে দাঁড়াবে না।তাই শুধু আক্ষেপে মনটা শূন্যতায় ভরে উঠছিলো,আর ভাবছিলাম কবে এমন প্রকৃতির মধ্যদিয়ে হেঁটে
বেড়াতে পারবো।বাসের জানালার কাচেঁর ভেতর থেকে ক্যামেরার সাটারিং স্পিটিট কয়েকবার পরিবর্তন করে চলন্ত বাস থেকে প্রকৃতির স্থিরচিত্র ধারণের চেষ্টা করলাম কিন্তু মন মতো ছবি না পাওয়ায় বিরত থাকলাম,তার উপর পাশের সহযাত্রীনীর অসুবিধের কথাও ভাবতে হলো।মনোনিবেশ করলাম নিবিড় করে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবগাহনের দিকে।প্রায় সারে তিন ঘন্টা যাত্রার পর পৌছুলুম
আপন সীমানায়,ফরাসী পুলিশের পরিচয়পত্র পরিক্ষা পর্ব শেষ করে বাস এবার ছুটে চলতে লাগলো ফরাসী ভূমির উপর দিয়ে।ফরাসি ভূপ্রকৃতির দিকে তাকালে যে কারো মনে হবে,এ যেন এক শুশৃংখল সাজানো গোছানো শিল্পী রঙ তুলীতে আঁকা এক ক্যানভাস।শিল্পী যেভাবে চেয়েছে ঠিক সেই রূপে আকৃতি ধারণ করে প্রকৃতি যেন মানবকুলকে বিমোহিত করছে।ফরাসিরা একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের জাতি,প্রতিটি কাজে শৃংখলা,শিল্পবোধ ও শতভাগ শুদ্ধতা কামনা করে এবং কোন কাজ সেইভাবে সম্পূর্ণ না হলে কিছুতেই যেন মানুসিক তৃপ্তি নিতে পারেনা।এই অভ্যস যেন ওদের অস্থিমজ্জাগত হয়ে গিয়েছে।প্রাত্যাহিক জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম থেকে শুরু করে,প্রশাসনিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে তা বিদ্যমান,তা থেকে বাদ যায়নি তাদের ভূপ্রকৃতিও।ক্ষেত খামার থেকে শুরু করে পর্বতমালা,নদী এবং বনবাদারের ডালপালাগুলো যেন নিয়ন্ত্রণাধীন।এ দেশের যে কোন দিকে তাকালে মনে হবে এ যেন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা কোন এক বাড়ীর আঙিনা।তারই প্রভাব চাক্ষুস ধরা পড়লো এই ফেরার পথে।কোথাও বিস্তৃর্ণ সমতল ফসলী জমি,সেই ধু ধু মাঠ জুড়ে রোপিত হয়েছে আঙুরের চারা।শুনেছি আঙুর বাগানের কথা,কিন্তু এবার
প্রথম বারের মত দেখা মিললো আঙুর ক্ষেত,যা আমাদের দেশের ধান গম বা অন্যান্য ফসলী ক্ষেতের মত।বুঝতে পারলাম পানির দরে কিভাবে ফ্রান্সে মদ কিনতে পাওয়া যায়।কারণ এখানকার উৎপাদিত আঙুর চলে যায় নামিদামী মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানাগুলোতে, আর সেখানে ব্যবহার হয় মদ তৈরীর মূল কাঁচামাল হিসেবে।আঙুর ও মদের সহজলভ্যতার কারণে ফরাসিদের প্রাত্যাহিক দিনের খাবার টেবিলে ওয়াইন এবং উৎসব আনন্দের দিনে শ্যাম্পেন ভরা একটি গ্লাস থাকা যেন ঐতিহ্য।মদের গ্লাস ব্যতিত রেস্তোরার টেবিলের আড্ডা যেন অর্থহীন।পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ফরাসি মদের বিশেষ চাহিদা ও সুনাম রয়েছে।
সুদূরে সূর্যের অপরাহ্ণের আলো পড়েছে বিশাল পাহাড়ের বুকে,।বাসে বসে দূরের এই পর্বতমালাগুলো দেখতে মনে হচ্ছিলো অনেকটা রূপালী বর্ণের জ্বলন্ত নক্ষত্রের মত।ভাবছিলাম, ফ্রান্স যে কতটা বৈচিত্রময় ভূপ্রকৃতি দেশ তা সড়ক পথের এই ভ্রমণে না আসলে অজানাই থেকে যেত।শহরের ইট পাথরের মধ্যে বসবাসের কৃত্রিম জীবন যাপন থেকে শুধু ইন্টার্ণেটের চিত্র দেখে এই বৈচিত্রতা উপলব্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়।মনে হলো সুন্দর ও সার্থক একটি ভ্রমণ শেষ করতে যাচ্ছি,যা স্মৃতির পটে অম্লান হয়ে থাকবে দীর্ঘ দিন।বার্সেলোনা থেকে ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে যাত্রা শুরু করেছিলাম কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগে প্যারিসের পৌঁছে দেখতে পেলাম প্রকৃতির ভীষন গোমরা রূপ,বৃষ্টিরূপে অঝরে ঝড়ছে প্রকৃতির কান্নার জল,ভোর পাঁচটার ব্যারসি বাস ষ্টেশনে নেমে প্রকৃতির সেই কান্নার জলে গা ভিজিয়েই পৌঁছুলুম আপন নীড়ে।
১.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-১) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
২.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-২) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৩.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-৩) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৪.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-৪)পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৫.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-৫) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন