বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।বাইরের খোলা বাতাসকেও এখন সন্দেহ হয়। টিভিতে আলোচনায় উঠে আসে একটি সাধারণ প্রশ্ন ,লক ডাউন চলছে, তবুও কেন বাড়ছে কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অনেকেই সন্দেহাতীত ভাবে প্রশ্ন করেন, ভাইরাস কি বাতাসেও উড়ছে? 

এমন পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেললাম।

সিদ্ধান্ত নিলাম বাইরে গিয়ে আর দৌড়াবো না। আমার বাসার বারান্দা বেশ লম্বা, প্রায় ২০ স্কয়ার ফিট। এখন থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় বারান্দার এপার ওপার একশত বার প্রদক্ষিণ করলেও কিছুটা ব্যায়ামের কাজ হবে।সেই ভাবেই শুরু হল নতুন করে সামনের লক ডাউনের দিনগুলো। বাইরে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিলাম। ঘরের মজুদ খাদ্য সামগ্রীও কমতে শুরু করেছে। হিসেব করে ব্যয় করছি। সুপার মার্কেটে যাওয়ার সাহস হয়না।কারণ,সুপার মার্কেটে চাকুরী করা অনেক ক্যাশিয়ার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া গেছে।এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের আরও কঠোর ভাবে গৃহবন্দী করার সংকল্প করলাম। 


প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে বাবার উদ্বিগ্নতায় ভরা কণ্ঠ ফোনে ভেসে আসে।অনেক পরিচিত বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী ফেচবুক মেসেঞ্জারে আমাদের খোঁজ খবর নেয়।অবাদ তথ্য প্রবাহের যুগে অন্য দেশের খবরাখবর জানা এখন আর অসাধ্য নয়। প্রতিদিন ক্রিকেট স্কোর বোর্ডের মত প্রতিটি দেশের করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর প্রচার হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে।এপ্রিলের মাসের দিকে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় কাটাছে ইতালি, স্পেন এবং ফ্রান্স।এই সব দেশে থাকা প্রতিটি প্রবাসীর আত্মীয় স্বজনরাই দুশ্চিন্তার সময় পার করছে  দূরের স্বজনদের নিয়ে।এদিকে আমরা এখানে শুধু টেলিফোনে কথা বলা ছাড়া পরিচিতজনদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সময় পার করছি।

পরিবেশ অনেকটা এমন, চারদিকে অথৈ পানি, কোন এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আমাদের বসবাস।ভেতরে আতংক।বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রাণনাশী শত্রু।কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত নির্জন জনপদে প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে আছি আমরা।আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির মানুষদের প্রকৃত অবস্থা কি তার সঠিক তথ্য কারো কাছে নেই।ফেচবুকের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পেজ থেকে কিছু ভাসা  ভাসা খবর ভেসে আসে।আমাদের একান্ত পরিচিত বন্ধুদের খবরা খবর রাখার এক মাত্র অবলম্বন টেলিফোন।

সংস্কৃতি অনুরাগী হাসনাত জাহান আপা আমাদের প্রিয়জন।সত্তরের দশকের শেষের দিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসেছিলো এই ভূখণ্ডে।চল্লিশ বছরের উপর ফ্রান্সে বসবাস।এই দেশের ছেলে মেয়েদের ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। কমিউনিটির নতুন পুরাতন অনেক মানুষের সাথে তার হৃদ্যতা ও যোগাযোগ।বয়স্ক মানুষ, তার উপর একা থাকেন।এই সময়টা তার জন্য বেশী ঝুঁকির।সকল পরিচিতজন তাকে ফোন করে খবর রাখে। আমার সাথে মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় কথা হয়।ওনার কাছ থেকে কমিউনিটির কিছু খবর মেলে।খবরগুলো কানে কানে শোনা।

আপা জানালেন, সাতু দো ফনতেন ব্লু এলাকায় এক বাংলাদেশী যুবক মারা গেছে।লোকটি হার্ডের সমস্যা নিয়ে হসপিটালের ভর্তি হয়েছিলেন।পরে ডাক্তার তার স্ত্রীকে জানায়, তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।পরবর্তীতে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ লোকটির সাথে আর পরিবারের লোকদের দেখা করতে দেয় না।তিনদিন পর পর হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পরিবারকে জানায় লোকটি মারা গেছে।লোকটি বয়সে তরুণ, দুই সন্তানের জনক।শুনে খুব কষ্ট হচ্ছিলো প্রবাসী ভাইটির এমন পরিণতির জন্য।সেই সাথে স্বজনহীন এই ভিনদেশে তার তরুণী স্ত্রী ও দুইটি সন্তানের ভবিষ্যৎ সংগ্রামের কথা ভেবেও খুব হতাশ হচ্ছিলাম। 


প্রথম দিকে অনেকের মধ্যে সন্দেহ ছিল, করোনা আক্রান্ত মানুষদের কি হসপিটাল কর্তৃপক্ষ যত্নসহকারে চিকিৎসা করছে? মৃতদের লাশ কি করছে?পুড়িয়ে ফেলছে নাকি গণকবর দিচ্ছে।নানা গুজব কথাবার্তাও উড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীতে যখনই কোথাও কোন যুদ্ধ বিগ্রহ,দুর্যোগ বা মহামারী লাগে তখন সত্য খবরের পাশাপাশি নানাবিধ গুজব খবরও বাতাসের বেগে ঘুরে বেড়ায়।বিষয়টি চিরাচরিত। মানুষ দিশেহারা সময়গুলোতে খবরের সত্যতা যাচাইয়ের মানসিকতা হারিয়ে ফেলে ফলে অনেক গুজব খবর সত্যের মত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।করোনা ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম থেকে জেনে আসছি ভাইরাসটি মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয়, এবং এটি প্রানিবাহিত একটি ভাইরাস।কিন্তু গৃহবন্দি সময়ে নতুন করে জানলাম প্যারিসের শ্যেন নদীর পানিতে নাকি এই ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই নদীর পানি স্পর্শ করলে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।খবরটি কয়েকদিন ফোনে ফোনে একজনের  কান থেকে অন্যের কানে দৌড়ে বেড়াল। অনেকের ফেচবুক স্ট্যাটাসেও ভেসে বেড়াল।যার ফলে, চরম ভীতিকর সময়ে ফ্রান্সের মানুষের মধ্যে ভীতি আরও ঘনীভূত হল।       

 

টেলিভিশনে মাঝে করোনা ভাইরাসের সংক্রমে প্রাণ হারানো বিভিন্ন স্বজনদের উপর প্রামাণ্য চিত্র দেখায়।একদিন  মারী  নামের এক সত্তর ঊর্ধ্ব ফরাসি মহিলা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলছিল, আমাদের দাম্পত্য জীবন চল্লিশ বছরের।ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।সুখ দুঃখ, হাসি আনন্দে পারি দিয়েছি জীবনের এতোটা বছর।এই বয়সে আমরা একে অপরের উপর খুব নির্ভরশীল ছিলাম।হঠাৎ ছেবাসতিয়া’র ঠাণ্ডা কাশি শুরু হল, পরে প্রচণ্ড জ্বর।জরুরী নম্বরে ফোন করলাম।এম্বুলেন্স এসে ওকে নিয়ে গেলো।দুইদিন পর হসপিটাল থেকে জানানো হল,ছেবাসতিয়া করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত।ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি ওর সুস্থতার জন্য। প্রতীক্ষা ছিল সুস্থ হয়ে ছেবাসতিয়া ফিরে আসবে।কিন্তু পাঁচ দিন পর হসপিটালের নম্বর থেকে ভেসে আসে ওর মৃত্যুর সংবাদ।ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, এতো বছর যে মানুষটির সাথে একই ছাদের নিচে কাটল, সেই মানুষটিকে শেষ বেলায় আমি সেবা করতে পারিনি।জীবনের  কঠিন সময়ে ওর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ জুটল না।চলে যেতে হবে জানি, কিন্তু ওর এমন বিদায় মেনে নিতে পারিনা, মনে পড়লে কষ্টে বুক ভারী হয়ে ওঠে। 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন