আমাদের পেই দো লা লোয়ার ভ্রমণের দিনগুলো স্বপ্নের মত শেষ হয়ে এলো।বিরামহীন যাত্রার মত গত তিনদিন ছুটে বেরিয়েছি নন্ত,ছা-নাজায়ার,পর্ণিক শহর।আবার কখনো এই অঞ্চলে আসা হবে কিনা, জানিনা।এই ছোট্ট শহরের রাস্তাঘাট,ট্রাম স্টেশন, রেস্তোরাঁ, লোয়ার নদী আমাদের কাছে বেশ আপন হয়ে উঠেছে।তাই ফেরার বেলায় কিছুটা বিদায়ের বিরহ বেদনা হৃদয়ের এককোণে জেগে বসল।
মনে হচ্ছিলো,প্যারিস ছেড়ে নন্ত শহরের এককোণে আমরা নতুন করে সংসার শুরু করেছি।আমাদের এই নতুন সংসারে কারুরই নিত্য দিনের কাজের তাড়া ছিলোনা,আমাদের প্রধান কাজ ছিল ঘোরাঘুরি আর দিনশেষে ভ্রমণ ক্লান্তি নিয়ে ক্ষণিকের এই নীড়ে ফেরা।গত চারদিনের আমাদের রুটিনটা ছিল এমন।
ভাড়া চুক্তি অনুযায়ী সকাল এগারোটার পূর্বে আমাদের বাসা ছেড়ে দিতে হবে।প্যারিস ফেরার বাস ছাড়বে বিকেল চারটায়। দিনের অনেকটা সময় আমাদের হাতে। এই সময়টুকু শহরের মধ্যে ধীরস্থিরভাবে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে সকাল সারে দশটার দিকে সবকিছু গোছগাছ করে আমাদের ক্ষণিকের সংসারের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লাম নন্ত ছন্ত ভিল Nante centre ville এর দিকে। মিডিয়াটেক ট্রাম স্টেশনে নেমে আমরা সরাসরি চলে গেলাম এপার্টমেন্ট ভাড়া প্রদানকারী কোম্পানির অফিসে। আমাদের ব্যাগগুলো এই অফিসের একজন কর্মরত তরুণীর নিকট রেখে বললাম দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা ব্যাগগুলো নিতে আসবো। আমাদের আজ তেমন কোন তাড়া নেই,তাই এখান থেকে বেরিয়ে খুব ধীরস্থির পায়ে রাস্তার দুই ধারের পুরনো স্থাপত্য নিদর্শনগুলো দেখতে দেখতে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগুতে লাগলাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নন্ত শহরের অন্যতম এক পর্যটন স্থান পাছাজ পম্মেেরেতে « Passage Pommeraye » ।
এটি ছয় শতকের একটি অভিজাত দুর্গ।বর্তমানে দুর্গটি ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, রেনেসাঁ শৈলী ও মধ্যযুগের একটি স্মৃতিচিহৃ হয়ে নন্ত শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে।
নিচ তলার দুর্গের কাউন্টারর থেকে আমরা তিনটা টিকেট ও দুর্গের ইতিহাস এবং নক্সা সম্বলিত একটি ব্রুসিওর সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম।পরে অন্যান্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে অমসৃণ দেয়ালের সিঁড়ির সরু পথ বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে এলাম উপরে।ভেতরের প্রথম কক্ষের দেয়ালের গায়ে সারি সারি ভাবে টাঙ্গানো রয়েছে রাজপরিবারের ঐতিহাসিক নানা ব্যক্তিবর্গের ছবি সঙ্গে তাদের জীবন বৃত্তান্ত ও কর্মজীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আমরা পড়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম।নিরাপত্তা বলয়ে পরিবেষ্টিত চতুর্ভুজ দুর্গটির মাঝে বিশাল আয়তনের উঠান। ছাদের উপড়ে গলির রাস্তার মত চলাচলের সরু পথ।এই পথ ধরে দুর্গটির চতুর পাশে পরিভ্রমণ করা যায়। ছাদের এই চলাচলের উন্মুক্ত স্থানের নিরাপত্তা দেয়াল এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সৈনিকেরা সশস্ত্র অবস্থায় সতর্কতার সঙ্গে অবস্থান করতে পারে । ছাদের এই চলাচলের জায়গা তেমন নক্সায় তৈরি করা হয়েছে। আমরা এই পথ অনুসরণ করে দুর্গটির চতুরদিক ঘুরে শেষ করলাম।দুর্গের অনন্যা তলার বিভিন্ন কক্ষ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।যেখানে রাজপরিবারের নানা ব্যবহার্য বিলাসজাত পণ্য, চিত্রকর্ম সাজিয়ে রাখা হয়েছে।আমরা সময় স্বল্পতার কারণে অনেক কিছু পরিদর্শন বাদ রেখেই দুর্গের নিচে নেমে এলাম। কিছু সময় প্রশস্ত উঠানে হাঁটাহাঁটি করে বেরিয়ে এলাম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাতো দে দুক দো ব্রুতান থেকে।
দুর্গের বাইরে চারপাশ শহরের মূল ভূমি থেকে পানিবিহীন দীঘির মত সুগভীর ঘাদ।হয়তো দুর্গ থেকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রাথমিক বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে দুর্গের চারপাশে এভাবে পরিকল্পিত ভাবে খনন করা হয়েছে।এই দীঘিটি সেই সময় হয়তো পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকলেও এখন শুধুই একটি সাজানো গোছানো খাল।খালের নিচ থেকে উপড়ে ওঠার জন্য বেশ কয়েকটি সিঁড়ি রয়েছে। অনেক স্থানীয় ও পর্যটকের দল এই খাদের সুবুজ উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। মিশেল ও সুমিকে কিছু সময়ের জন্য এখানে রেখে আমি চলে গেলাম কে দে প্লন্ত Quai des plantes অর্থাৎ গাছপালার ঘাট বা প্লাটফর্ম পরিদর্শন করতে।বাগানটির নক্সা করা হয়েছে ট্রেন স্টেশনের প্লাটফর্মের মত করে।যার দরুন এমন নামকরণ করা হয়েছে। সাতো দে দুক দো ব্রুতান থেকে ট্রামে উঠলে তিন স্টেশন পরেই কে দে প্লন্ত। কে দে প্লন্ত হল নন্ত সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃক লোয়ার নদীর ধারে বানানো একটি ছোট বাগান।বাগানটি আন দো ব্রেতান ব্রিজ থেকে লা গার মারিতিম পর্যন্ত লম্বা। ৬০০ মিটার লম্বা এই বাগানটিতে ২০০ প্রজাতির ১৫০০ গাছ রোপিত রয়েছে। গাছগুলো বড় ড্রাম আকৃতির টবের মধ্যে রোপণ করা। লম্বা বাগানটির মাঝখান দিয়ে হাঁটার পথ, মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চ বসানো।নগর জীবনের ব্যস্ততার ক্লান্তি দূর করতে বৃক্ষ প্রেমীরা সবুজের স্পর্শ নিতে ছুটে আসে এই লোয়ার পারের বাগানে।
ফরাসিদের একটা জিনিস আমার খুব পছন্দ।তাহলো, প্রতিটি আবাসিক এলাকায় শিশুদের খেলাধুলার জায়গা সংরক্ষণ করা এবং জনসাধারণের দেহমন সজীব রাখার জন্য সবুজ গাছপালা সমৃদ্ধ হাটার স্থান বাধ্যতামূলক ভাবে গড়ে তোলা।স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন এই কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করে থাকে। যে আজকে শিশু সে রাষ্ট্রের আগামী নেতৃত্ব। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যদি পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ নিয়ে গড়ে না ওঠে তবে জাতি অদূর ভবিষ্যতে বিপদের সম্মুখীন হবে অবধারিত, এই ধারনা থেকে ফরাসিরা শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা, বই পড়া,ছবি আঁকা,ভ্রমণ, শিল্প সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি কল্পে শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে তুলেছে খেলার মাঠ সহ নানা বিনোদন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
একটি জাতির শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের উপর নির্ভর উন্নয়নের অগ্রযাত্রা।অসুস্থ জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কখনো সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করা যায়না। এই বিষয়টি ফরাসিরা গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করে। তাই ফ্রাসের প্রতিটি শহরে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলেছে,বৃক্ষরাজি ঘেরা পার্ক, লেক, হাটার জায়গা।প্রতিটি রাস্তার পাশ দিয়ে রয়েছে সাইকেল চালানোর নির্ধারিত স্থান। শহরতলির আশেপাশের প্রাকৃতিক বনভূমি ও জলাভূমিগুলোতে জনসাধারনের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য করে রেখেছে নানা আয়োজন।যার দরুন ফ্রাসের শহরের মানুষদের সবুজের সংস্পর্শে বুক ভরে মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য ছটফট করতে হয় না।
যখন কে দে প্লন্ত পরিদর্শন শেষে সাতো দে দুক দো ব্রুতানের দিকে ফিরছিলাম তখন মনে হল চারদিন ধরে পেই দো লা লোয়ার অঞ্চলের তিনটি শহরে আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এ কদিনে কোথাও একজন বাঙালির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি।আমরা প্যারিসে অনেকটা বাংলাদেশের মতই জীবন যাপন করি।প্রবাসের নিঃসঙ্গতার কষ্ট খুব একটা স্পর্শ করেনা আমাদের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই উচ্চশিক্ষা, রাজনৈতিক আশ্রয়, বিভিন্ন বৃত্তিসহ নানা ভাবে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মানুষের শিল্প সংস্কৃতির তীর্থভূমি ফ্রান্সে আগমন ঘটে। শুরুতে এ সংখ্যা নেহায়েত হাতে গোনা হলেও বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজারের কোঠায়।এই সংখ্যার অধিকাংশই রাজধানী প্যারিসে বসবাস করে। এছাড়া তুলুজ, তুলোন, বেস্ট, মারছেইসহ ফ্রান্সের অন্যান্য শহরেও বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস রয়েছে। এখানকার প্রত্যেক বাঙালি জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাস করলেও সবার বুকের এক কোণে রয়েছে ছোট্ট একখন্ড বাংলাদেশ প্রতিচ্ছবি।তাই স্ব স্ব পেশার পাশাপাশি শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চা ইত্যাদিতেও রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশের মতো এখানেও বাঙালির চিরাচরিত অনুষ্ঠান—শহীদ দিবস, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা এবং অন্যান্য উৎসবগুলোর আনন্দ প্রবাসীরা মিলেমিশে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যথেষ্ট উৎসাহ ও উদ্দীপনায় উদযাপন করে থাকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো জাতীয় দিবসগুলো। এছাড়া রবীন্দ্র-নজরুল ও অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন যেন এক দেশীয় আমেজের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র লাল টিপ ফ্রান্স প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী এনায়েত উল্লাহর প্রযোজনা ও প্রবাসী স্বপন আহমদের পরিচলনায় প্যারিসেই নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বসবাস এই ফ্রান্সের প্যারিস এবং প্যারিসের আশেপাশের শহরে।যাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও একুশে পদকপ্রাপ্ত মুকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুদার, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ উল্লেখযোগ্য, এছাড়া প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও সনামধন্য আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনও এই প্যারিস শহরেই বসবাস করতেন।
সাহিত্যপিপাসু প্রবাসীদের উদ্যেগে মাঝে মাঝেই প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও ছড়া সংকলন। এছাড়া নিয়মিতভাবে বাংলা পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাও বের করা হয় ।
নতুন প্রজন্মেকে তার শেকড়ের সঙ্গে পরিচয় করে দেবার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে বাংলা শিক্ষার স্কুল।এছাড়া
কমিউনিটির বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রশাসনিক ও তথ্য সংক্রান্ত সেবা প্রদানদের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সহায়তা কেন্দ্র।
দেশের যে কোনো রাজনৈতিক সংকট ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো এখানেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এখানে শাখা রয়েছে। প্রত্যেকেই যার যার দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে থাকে। আবার অনেকেই স্বপ্ন দেখেন দেশের প্রচলিত রাজনীতির ধারা ভেঙ্গে নতুন আঙ্গিকে একটি বাংলাদেশ গড়ার। এর পরিপেক্ষিতে এখানকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রবাসীদের দেখা যায় দেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড, দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাস ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ব্যানার ফেস্টুন হাতে প্রতিবাদ জানাতে।
আড্ডা দিয়ে ও খোশ গল্প করে সময় কাটানোয় বাঙালিদের বিশেষ জুড়ি রয়েছে, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। প্যারিসের গারদো নর্থ, লাশাপেল, ক্যাথসমা প্রভৃতি এলাকার রেষ্টুরেন্ট, ক্যাফে বার ও রাস্তার পাশগুলো প্রতিদিন জেগে ওঠে বাঙালিদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক আলোচনা ও হাসিঠাট্টায়।
বাংলাদেশী পণ্য সামগ্রীর দোকানপাট,রেস্তোরাঁ প্যারিসের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে দেখা মেলে। তাই প্যারিস ও প্যারিসের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষের বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নিজস্ব গোত্রের মধ্যে উৎসব আনন্দ ও ভাবের আদান প্রদান লেগেই থাকে।
আমাদের একটি কবিতা পাঠের সংগঠন রয়েছে, নাম অক্ষর। আমরা নানা উপলক্ষে কবিতা পাঠের আয়োজন করি। আমাদের এই কবিতা পাঠের আসরের নিয়মিত বন্ধুরা একে অপরের আত্মীয়র মত।কবিতা পাঠের আসরে শিল্প সাহিত্য নিয়ে আড্ডা, সঙ্গে বাঙালি খাবারের স্বাদ যেন প্রবাসের বুকে প্রাণের আনন্দ সঞ্চার করে।আমাদেরকে ভুলিয়ে দেয় স্বজনহীন সাত হাজার কিলোমিটারের দূরত্বের কষ্ট।
পেই দো লা লোয়ার অঞ্চলের কোথাও না কোথাও অবশ্যই বাঙালি পরিবারের বসবাস আছে, আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু এই চার দিনে কাউকে ডেকে বলতে পারিনি ভাই আপনি কি বাঙালি, কেমন আছেন? দূর পরবাসে নিজস্ব ভাষার একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া মানে একজন পরম আত্মীয়ের সন্ধান লাভ করা। নন্ত একটি সাজানো গোছানো চকচকে তকতকে শহর।দূর থেকে এমন একটি সুন্দর শহরে বসবাস করার ইচ্ছে যে কারো জাগবে। কিন্তু আমার মধ্যে এই চারদিনের ভ্রমণ শেষে একটি পরম উপলব্ধি হয়েছে, যা পূর্বে কখনো এভাবে অনুভব হয়নি। মানুষের যদি নিজস্ব ভাষায় ভাবের আদান প্রদানের সুযোগ না থাকে তাহলে এমন জীবন অনেকটাই সোনার খাঁচায় বন্দী পাখীর মত। আমি মনে মনে কল্পনা করেছি,নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি, যদি এই শহরে আমার ভালো বেতনের একটি চাকুরী হয়, চাকুরীদাতা ভালো একটি এপার্টমেন্ট দেয় তাহলে এখানকার আমার জীবনের আনন্দ কেমন হবে? সারাদিন সহকর্মীদের সঙ্গে সারাদিন ফরাসি ভাষায় কথা বলতে হবে। রাস্তাঘাট, বাজার, ট্রামে চেনা মানুষের দেখা মিলবে না। ফরাসি বা অন্য জাতিগোষ্ঠীর কোন সহকর্মী অথবা প্রতিবেশীর আমন্ত্রণে গিয়ে শ্যাম্পেন, কেক,শামুক অথবা স্যামন মাছ খেতে হবে। এমন জীবনধারায় দেহের মধ্যে প্রাণ থাকবে,বাহ্যিক চলাফেরায় পরিপারি দেখাবে ঠিকই কিন্তু মনটা শুকনো মরমরে পাতার মত একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। ফরাসিতে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, প্রিছন দর « Prison d’or » অর্থাৎ সোনার জেলখানা। কথাটির মর্মার্থ হল, কোন মানুষকে যদি চাকচিক্য কোন পরিবেশে থাকতে দেয়া হল, বা কাজ করার সুযোগ দেয়া হল কিন্তু এমন সুন্দর পরিবেশের মধ্যে যদি পারিপার্শ্বিক কারণে ঐ ব্যক্তি নিজেকে অসুখী অনুভব করে তবে এমন পরিবেশকে প্রিছন দর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সুতরাং যে পরিবেশে মানুষ নিজেকে সুখী অনুভব করতে পারে না সেই পরিবেশ বাইরে থেকে দেখতে সোনার মত চকচকে হলেও তাকে জেলখানা ছাড়া অন্যকিছু বলা যায়না।কোন মানুষ যদি বস্তি এলাকায় বসবাস করে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে তবে ঐ চাকচিক্য পরিবেশর জীবন থেকে তার বস্তি জীবনই যেন স্বর্গবাস। নিজের দেশ ও দেশের মানুষকে আমরা যত সমালোচনা করি না কেন, নিজ জাতিগোষ্ঠী যত পশ্চাৎপদই হোক না কেন, আত্মার শান্তির প্রকৃত উৎস নিজের মায়ের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, নিজ গোত্র বর্ণের মানুষ মধ্যেই অন্তর্নিহিত থাকে।এক কথা মনে হয়ে কারো অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমি নতুন কোন অঞ্চলে গেলে সেই অঞ্চলের নিয়মকানুনগুলো লক্ষ্য করি।এবার নন্ত শহরে ঘোরাঘুরির মধ্যে একটা ব্যাপার আমার কাছে একটি বাতিক্রম লেগেছে। তাহলো, এই শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা।ট্রাফিক নিয়ম কানুন প্যারিসের মত হলেও গাড়ি চালকদের আচরণ ভিন্ন।ফ্রান্সে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হয় ডিজিটাল পদ্ধুতিতে কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে। অর্থাৎ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে কোন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকেনা।গাড়ি চালক ও পথচারী উভয়ই সিগন্যালের লাল বাতি ও সবুজ বাতি অনুসরণ করে রাস্তা পারাপার হয়। উভয় পক্ষই ট্রাফিক আইনকে সর্বদা শ্রদ্ধা করে। ফলে ফ্রান্সে সড়ক দুর্ঘটনা হার উল্লেখ করার মত নয়।
নন্ত শহরে যতবার আমরা ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে রাস্তা পারাপারের জন্য সবুজ বাতির অপেক্ষা করেছি, ততবারই অবাক হয়েছি। সাধারণত সিগন্যালে লালবাতি থাকলে গাড়ি পার হবে আর পথচারী সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকবে সবুজ বাতির অপেক্ষায় কিন্তু আমরা যতবারই সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকেছি ততবারই গাড়ি চালক রাস্তার মধ্যে গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে হাতের ইশারায় রাস্তা পারাপারের সুযোগ করে দিয়েছে।যেটা তাদের করার কথা নয়। এমনটা আমি অন্য কোন শহরে লক্ষ্য করিনি। প্যারিস ব্যস্ত শহর, তাই কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু সাধারণতই করেনা। নন্ত শহরে মানুষের হুড়োহুড়ি অন্য শহরের মত নয়। তাই হয়তো এই শহরের গাড়ি চালকেরা নিজের অধিকার ছাড় দিয়ে পথচারীর অপেক্ষার কষ্টকে লাঘবের জন্য এমন উদারতা দেখাতে পারে।
আমাদের দেশে শুধু অনিয়মতান্ত্রিক ট্রাফিক ব্যবস্থা ও জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইনের না মানার প্রবণতার কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষ রাস্তায় অকালে প্রাণ হারায়।
ঢাকায় ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঘটনার দিন থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার রাজপথ সহ সারাদেশে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক সিগন্যালগুলোর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছাত্ররা নিজের হাতে তুলে নেয়। বিক্ষোভের মুখে নিয়ন্ত্রণ হারানো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরদের পরিচালিত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ চেয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এই আন্দোলনের মাধ্যমে একটা ব্যাপার দারুণ ভাবে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে দেশের নীতিনির্ধারণী স্তর পর্যন্ত কেউই ট্রাফিক আইন মেনে চলে না।রাস্তায় মোটরযান চালানোর সময় সাধারণ মানুষ যেমন গাড়ির বৈধ কাগজপত্র সঙ্গে রাখে না তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মীরাও সরকারী দায়িত্ব পালনকালে গাড়িতে আইনানুগ কাগজপত্র সঙ্গে রাখে না।যা ক্ষুদে বিক্ষোভকারীরা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আন্দোলনটি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন লাভ করায় গণবিক্ষোভে রূপ লাভ করে। প্রবাস থেকেও এই আন্দোলনের সমর্থনে নানা কর্মসূচী পালিত হয়। আমি নিজেও অনেক সময় দেশের এমন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে আবেগঘন অনেক কথা ফেচবুকের পাতায় লিখেছি। মনে হতো, সরকারের দায়িত্বশীলদের অযোগ্যতা ও দেশের মানুষের নিরাপত্তার প্রতি তাদের উদাসীনতার কারণে মানুষকে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে অঘটনের শিকার হতে হয়।কিন্তু, দীর্ঘ আট বছর পর যখন ২০১৯ সালে দেশে গেলাম তখন আমার একতরফা ধারণা সম্পূর্ণটাই বদলে গেলো।বুঝতে পারলাম আমাদের ঢাকা শহরের অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থার মূল কারণ এবং এই সমস্যার উত্তরণের পথ।
আমাদের দেশে এখনো ট্রাফিক বাতি এবং পুলিশের মাধ্যমে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়।ঢাকা শহর যে পরিমাণ মানুষের বসবাস এবং রাস্তায় তাদের যে ধরণের কর্মব্যস্ততার ছোটাছুটি তাতে মানুষকে ট্রাফিক আইন শিখিয়ে এবং পৃথিবীর যত প্রকার উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রচলন আছে তা ঢাকা শহরে প্রয়োগ করলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সমস্যার পূর্ণ সামাধান সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সরকারের দায়িত্বরশীলরা জনগণ বান্ধব নয় তা আমরা সবাই জানি। সরকার পরিবর্তন হয়ে অন্য যে কেউ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলেও তার পক্ষে ঢাকা শহরের এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ অপকর্ম যা করার আমরা সেটা আগেই করে ফেলেছি। অপিকল্পিত নগরায়নের কারণে আমাদের আজকের এই কুফল ভোগ করতে হচ্ছে।ব্যক্তিগত লোভ লালসাকে চরিতার্থ করতে ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীরা মিলে ঢাকা শহরটাকে একটি আধুনিক ঘিঞ্চি বস্তি শহরে রূপান্তর করছে।তার উপর জনসাধারণের অসচেতনতা,আইন না মানার দীর্ঘদিনের প্রবণতা ইত্যাদি ট্রাফিক সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।এই শহরে গাড়ি চালকরা যেমন বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালায় তেমনি পথচারীরাও ট্রাফিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে রাস্তা পারাপার হয়। এটি এই শহরের প্রতিদিনের চিত্র।এই সমস্যা সৃষ্টির পেছনে সরকার,গাড়ি চালক এবং পথচারী সব পক্ষই দায়ী থাকলেও সরকারের অব্যবস্থাপনাই এর প্রধান কারণ।
ঢাকা শহরের এই সমস্যা সমাধানের এক মাত্র পথ হল, মানুষ যে সমস্ত কারণে ঢাকামুখী হয়ে জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি করে সেই কারণগুলো খুঁজে বের করা। যেমন,চাকুরী, শিক্ষা,উন্নত চিকিৎসা, ব্যবসা বাণিজ্য, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি।সরকার যদি এসব নাগরিক সুবিধার যাবতীয় উপকরণগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের করতে থাকে তবে ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমতে থাকবে। এতে ট্রাফিক সমস্যা সহ নানাবিধ সামাজিক সমস্যার নিয়ন্ত্রণ করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য সহজ হবে।ঢাকা পরিণত হবে শৃঙ্খলিত ও স্বাস্থ্যসম্মত একটি আধুনিক নগরে। ফলে রাস্তায় দুর্ঘটনার সংখ্যা যেমন কমে যাবে তেমনি মানুষের জীবন যাপনও সহজ হয়ে উঠবে।অর্থাৎ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের দিকে নজর দেয়া ছাড়া এই নগর জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের হাতে বিকল্প আর কোন পথ খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না। ঢাকা হয়তো কখনোই নন্ত বা প্যারিসের মত নগরী হয়ে উঠবে না, তবে এই উন্নত শহরগুলোর মত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব।
এই কথাগুলো নন্ত শহরে দাঁড়িয়ে দারুণ ভাবে উপলব্ধি হচ্ছিলো।
আমাদের বাস ছাড়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এলো। কে দে প্লন্ত থেকে সাতো দে দুক দো ব্রুতানে ফিরে এসে সুমি ও মিশেলকে সঙ্গে করে চলে এলাম আমাদের ব্যাগগুলো নেয়ার জন্য এপার্টমেন্ট ভাড়া প্রদানকারী কোম্পানির অফিসে। আমাদের বাস ছাড়বে নন্ত শহর থেকে বেশ দূরের একটি ট্রাম স্টেশনের কাছ থেকে। আমরা একটু অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে ফেলেছি শহরের মধ্যে। আমাদের বাস ছাড়ার স্থান খুঁজে বের করতে হবে, তাই বেশ তাড়াহুড়ো করে আমরা দ্রুত পায়ে হেঁটে কমার্স ট্রাম স্টেশন এসে ট্রামে উঠলাম। আমাদের বাস ছাড়ার দশ মিনিট পূর্বেই চলে এলাম আমাদের গন্তব্যের স্টেশনে। ট্রাম থেকে নেমে স্থানীয় পথচারীদের কাছে জিজ্ঞেস করে দ্রুত বাস স্টেশনের দিকে চলে এলাম।আমাদের বাস খুঁজে পেতে কোন বেগ পোহাতে হলো না।তবে কোন কারণে কয়েক মিনিট দেরী করলেই বাস মিস করতে হতো। আমাদেরকে আরও সতর্কতার সঙ্গে ন্যূনতম আর ত্রিশ মিনিট আগে নন্ত ভিল থেকে ট্রাম ধরা উচিত ছিল। কারণ,দুর্ঘটনা এড়াতে অচেনা জায়গা খুঁজে বের করার জন্য সর্বদা সময় হাতে রাখা উচিত।
আমাদের বাস নির্ধারিত সময়ে পেই দো লা লোয়ার ছেড়ে প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ইট পাথরের শহর পেরিয়ে প্রবেশ করলো প্রকৃতি মাঝে।কখনো ধুধু প্রান্তর, কখনো প্রাকৃতিক বনভূমি মধ্য দিয়ে বাস এগিয়ে যেতে লাগলো।বাসের সব আসন পরিপূর্ণ না থাকায় আমি আর মিশেল মাঝে মাঝে আসন পরিবর্তন করে জানালা দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের করতে লাগলাম।মিশেল দীর্ঘক্ষণ ধরে জানালা দিয়ে বুনো খরগোস দেখার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু ওর চোখে ধরা পড়ছে না। ও বিরক্ত হয়ে ওর মায়ের কাছে চলে যেতেই আমার চোখে ধরা দিলো রাস্তার ধারের জঙ্গলের মধ্যে একটি বুনো খরগোসের ছোটাছুটির দৃশ্য।বিষয়টি মিশেলকে বলতেই ও আবার আমার কাছে এসে বসলো। আমরা দুজন আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিস্তীর্ণ ফসলী মাঠ, চোখের দৃষ্টির সীমানায় কোন মানুষ, বাড়িঘর নেই এমন বিরান পথের মধ্য দিয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চলছে।শেষ বিকেলের শান্ত শীতল বাতাস জানালা ভেদ করে এসে মুখে লাগছে।হঠাৎ চোখে ধরা দিলো হৃদয় ছোঁয়া একটি মনোরম দৃশ্য। মহাসড়ক থেকে কিছুটা দূরে মরা বুনো ঘাস ও ঝোপঝাড়ে ঘেরা ছোট্ট পুকুরের মত একটি পাকা পানির হাউজ, হাউজের এক পাড়ে সামনের দু পা কিছুটা ভেঙ্গে একটি বন্য হরিণের বাচ্চা পানি পান করছে।দৃশ্যটি মুহূর্তেই আমার হৃদয়কে ভাষাহীন ভালোলাগায় আন্দোলিত করলো। কারণ, জীবনে এই প্রথম আমার বন্য হরিণ দেখা।মিশেলকে হাতের ইশারায় দৃশ্যটি দেখাতে চেষ্টা করলাম , কিন্তু ও আমাকে বার বার, কোথায় হরিণ বাবা? জিজ্ঞেস করতে করতেই বাসের চলমান গতি দৃশ্যটিকে আড়াল করে দিলো। ফ্রান্সে প্রায় প্রতিটি মহাসড়কের দু পাশ দিয়ে প্রচুর প্রাকৃতিক বনভূমির দেখা মেলে। এই বনগুলোতে প্রচুর বন্য হরিণের বিচরণ রয়েছে।এই সব বন্যপ্রাণী শিকার করা ফ্রান্সে কঠোর ভাবে নিষেধ।মহাসড়কের যেসব এলাকায় বনভূমি রয়েছে সেসব এলাকায় মটর যানের গতিসীমা বেঁধে দেয়া রয়েছে এবং বিশেষত যেসব জায়গা দিয়ে হরিণ রাস্তা পারাপার হয় সেই জায়গাগুলোতে হরিণের চিহ্ন সম্বলিত সতর্কতা সংকেত বসানো রয়েছে। যাতে বন্যহরিণগুলো যেন কোন প্রকার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ না হারায়।
আমাদের বাস যে বিরান এলাকার মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল সেখান থেকে অনেক দূরে দূরে কিছু বন বাদাড় দেখা যাচ্ছিল, ঐ সব বন বাদাড়ে মূলত বন্য হরিণের আবাস।কোন মাংসাশী প্রাণী বা মাংস লোভী মানুষের দ্বারা শিকার হওয়ার ভয় না থাকায় এরা দিনের বেলায় খাস পাতা খাওয়ার জন্য জঙ্গল থেকে বিরান এলাকায় ছুটে আসে এবং নির্ভয়ে বিচরণ করে।এই বিরান মাঠে বিচরণ করা হরিণ, খরগোস,ব্যাঙ, সাপ পোকামাকড়ের পানির তৃষ্ণা মেটানোর সুবিধার্থে স্থানীয় প্রশাসন পাকা করে ছোট ছোট হাউজ বানিয়ে রেখেছে।
ফ্রান্সের প্রশাসন মানুষের নিরাপত্তা বা সুবিধার জন্য যেমন বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেন তেমনি বন্যপ্রাণী,পাখিদের সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্যও নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনার করে থাকে।যেমন, প্রত্যেকটা সিটি কর্পোরেশন বুনো কবুতর ও অন্যান্য পাখিদের আহারের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিদিন চাল,গম ছিটিয়ে দেয়। পাখীগুলো ক্ষুধা নিবারণের পর মনের আনন্দে আকাশ পানে ডানা মেলে। তাছাড়া ফরাসি জনগণ পশু পাখির প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, যার দরুন কেউ শস্য দানা হাতে করে এখানকার বুনো কবুতর, চড়ুই পাখির সামনে দাঁড়ালে পাখিগুলো অচেনা অজানা মানুষটির হাতে বসে খাবার খায়। বিন্দুমাত্র ভয় পায় না।আবার পোষা কুকুর বেড়ালকে ফরাসিরা নিজ সন্তানের আদর স্নেহে লালন পালন করে থাকে।ফ্রান্সে বছরে একবার জুলাই আগস্টের দিকে এক সপ্তাহের মত প্রচণ্ড তাপদাহ বিরাজ করে।পীচ ঢালা রাস্তা সূর্যের তাপে নরম হয়ে যায়।এই সময় দেখেছি অনেক ফরাসি পার্কের পোকা মাকড় ও পাখীদের কথা চিন্তা করে ছোট্ট পাত্রে পানি ভরে গাছের নিচে রেখে আসে। ফরাসিদের অন্য প্রাণী ও পাখির প্রতি এমন মমত্ববোধ আমাকে দারুণ ভাবে অভিভূত করে।
প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টধর্মীয় বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে লক্ষ লক্ষ ইউরোর ক্রিসমাস ট্রি বিক্রি হয়। এই গাছকে ফরাসিরা বলে ছাপা দো নোয়েল Sapin de Noël।বিভিন্ন দামে ছোট বড় এই ছাপা দো নোয়েল বিক্রি হয় ফুলের দোকান সহ বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে শুধু খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসী মানুষইরাই এই গাছ কেনে না, উদার চিন্তা ধারার অন্য ধর্ম বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী মানুষজনও ছাপা দো নোয়েল কিনে গাছটিকে শৈল্পিক ভাবে অঙ্গ সজ্জা করে ঘরের এক কোণে রেখে দেয়।এর কারণ, ইউরোপে বড় দিনের উৎসবটি মূলত শুধু ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে।এখানকার ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীরা সারা বছর গির্জায় না গেলোও এই উৎসবটি ধুমধাম করে পালন করে থাকে। বড় দিনের সঙ্গে ছাপা দো নোয়েলের সম্পর্ক যেন অঙ্গাঙ্গি।আমার ধারনা ছিল, এই বিশেষ গাছটি হয়তো বড়দিন উপলক্ষে বিভিন্ন বন থেকে কেটে এনে বিক্রি করা হয়। কিন্তু, বাসের জানালা দিয়ে যখন দেখছিলাম মাঠের পর মাঠ পরিকল্পিত ছাপা গাছের মাঠ, কোথাও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে রোপিত হওয়া ছোট ছোট ছাপা গাছের চারা তখন আমার ধারনা বদলে গেলো। এই গাছটির পুরো ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনন্যা ফসলের মতই বাণিজ্যিক ভাবে মাঠে চাষ করা হয় এবং বিক্রয় উপযুক্ত হলে নয়েল উপলক্ষে কেটে বাজারজাত করা হয় ।
বনবাদার, খোলা প্রান্তন মাড়িয়ে আমাদের বাস এসে থামল প্যারিসে। মনে হল, অনেক দিন যেন চেনা শহর থেকে দূরে ছিলাম। এই কয়েক দিনের বিরতিহীন ভ্রমণ আনন্দে ভুলে গিয়েছিলাম আমার বারান্দা বাগানের ফুল গাছগুলোর কথা।টানা চারদিন অনাহারে জীবন কেটেছে গাছগুলোর। বারান্দার কার্নিশে আমার প্রিয় মেরীগোল্ড ফুলের শত শত গাছগুলো কি বেঁচে আছে? যাদের শরীরে দিনে দুবেলা পানি ছিটিয়ে না দিলে নেতিয়ে পড়ে। বাস থেকে নেমে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় মনের মধ্যে এমন শঙ্কা জেগে বসলো ।বাসায় পৌঁছেই প্রথমেই ছুটে গেলাম বারান্দা বাগানে। বড় পাত্রে পানি ঢেলে যে গাছগুলো ডুবিয়ে রেখে গিয়েছিলাম সেই গাছগুলো আরও বড় হয়েছে। কার্নিশের গাছগুলোর পাতা শুকিয়ে ডাটা দাঁড়িয়ে আছে। টবের অনেক গাছের জীবন যায় যায় অবস্থা।আমি এক মুহূর্ত দেরী না করে গাছে পানি দেওয়ার ঝাঁঝরিতে দ্রুত জল ভরে বাগানের প্রতিটি গাছ ভিজিয়ে দিলাম।মনে হল,আমি যেন ধু ধু মরু পথ পেরিয়ে আসা একদল তৃষ্ণার্ত পথিকের পাশে শীতল জলের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করালাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বারান্দার টবের গাছগুলো আবার জেগে উঠেছে। নেতিয়ে পড়া পাতাগুলো আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সবুজের দ্যুতি ছড়াচ্ছে ……।।
পেই দো লা লোয়ার'য়ে চারদিন। পর্ব - ৪ ( পর্ণিক)
পেই দো লা লোয়ার'য়ে চারদিন। পর্ব - ৩ ( ছা-নাজায়ার)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন